ইসলাম ও বিনোদন
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
বিনোদন এমন এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যার প্রয়োজনীয়তার কথা আজকের দিনে সমস্ত বিবেকবান মানুষ স্বীকার করে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছেঃ বিনোদনের ব্যাপারে ইসলামের কি অভিমত? ইসলাম কি আদৌ তার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে কি না? এ প্রসঙ্গেই কিছু আলোকপাত করা আবশ্যক মনে করছি। প্রথমেই আমরা বেশ কয়েকটি দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।
ক) বিনোদন কি?
বিনোদন বলতে আমরা বুঝিঃ মনের মধ্যে সন্তুষ্টি, প্রশান্তি, খুশী ইত্যাদীর উদ্রেক করা ঘটানো। অন্য কথায়ঃ অবসর সময়ে এমন কাজ করা যাতে অন্তরে প্রশান্তি ভাব বিরাজ করে, অবসাদ দূর করে।
খ) বিনোদনের ইসলামী সংজ্ঞাঃ
বিনোদন বলতে এমন কিছু ক্ষতিমুক্ত কর্মকাণ্ডকে বুঝায় যা কোন ব্যক্তি, দল বা শ্রেণী স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইসলামী নিয়মনীতির উপর ভিত্তি করে আপন আপন অবসর সময়ে মানব মনের ভারসাম্যতা ও একঘেয়েমীভাব কাটানোর জন্য পালন করে থাকে।
গ) বিনোদনের গুরুত্ব
বিনোদনের গুরুত্ব অনেক, নীচে তার কিছু উল্লেখ করা হচ্ছেঃ
১• বিনোদন মানুষের আত্মিক, বিবেক ও শারিরীক চাহিদার মধ্যে সমন্বয় সাধন করে। কেননা মানুষ এ তিনদিকের শুধু একদিকে বেশী ঝুকে পড়লে তাকে সমুদয় কষ্টে পড়তে হয়, তখনই বিনোদনের মাধ্যমে অন্যান্য দিকে নজর দেয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
২• বিনোদনের মাধ্যমে মানুষ বিভিন্ন বিষয়ে অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারে, যা সাধারণ ভাবে হয়ে উঠেনা। আবার এর মাধ্যমে এমন নতুন কিছু প্রতিভার বিকাশ ঘটে যা সাধারণত অন্যভাবে বের হয়না।
৩• বিনোদনের মত বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করার মাধ্যমে খারাপ কাজ যথাঃ খুন-খারাবী, চুরি ডাকাতি, চিনতাই ইত্যাদী প্রবণতা থেকে মুক্ত থাকা যায়। কারণ তা মানুষকে সামাজিক করে তোলে। তার কর্মকান্ডের জন্য জবাবদিহিতার ভাব তার মনে উদ্রেক করে।
৪• যান্ত্রিক যুগ বলে পরিচিত এ যুগে বিনোদনের এমন প্রয়োজনীয়তা রয়েছে যা যে কোন চাকুরীজীবি মাত্রই স্পষ্টভাবে বুঝতে পারেন।
ঘ) ইসলামে বিনোদনের হুকুম কি?
ইসলাম বিনোদনকে বৈধ ঘোষনা করেছেঃ তার প্রমাণঃ
সাধারণ দলীলঃ
১) হানজালা (রাদিয়াল্লাহু আনহু)র হাদীসঃ তিনি বলেনঃ আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূলঃ হানজালা তো মুনাফিক হয়ে গেছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ “তা আবার কি?” আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমরা আপনার নিকট যখন থাকি, তখন আপনি আমাদেরকে জান্নাত, জাহান্নাম স্মরণ করিয়ে দেন, যাতে মনে হয় তা আমাদের চাক্ষুষ বিষয়। তারপর যখন আমরা আপনার কাছ থেকে বের স্ত্রী, সন্তান-সন্ততী ও খেত-খামার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি তখন অনেক কিছুই ভূলে যাই। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ “যার হাতে আমার প্রাণ যদি তোমরা আমার কাছে যে অবস্থায় থাক তার উপর সর্বদা থাকতে, জিকরে মাশগুল থাকতে তাহলে ফেরেশতাগণ তোমাদের বিছানায় এবং রাস্তায় তোমাদের মুসাফেহা করত, কিন্তু হে হানজালা ঘন্টা এবং ঘন্টা”। (সহীহ্ বুখারী: ২৭৫০)
২) আবু জুহাইফা বর্ণনা করেনঃ সালমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আবুদ্দারদা (রাদিয়াল্লাহু আনহু)র সাথে সাক্ষাত করতে গিয়ে তাঁর স্ত্রী উম্মে দারদা (রাদিয়াল্লাহু আনহা)কে বিমর্ষ অবস্থায় খারাপ কাপড় ছোপড় পরা অবস্থায় দেখতে পেলেন তিনি তাকে বললেনঃ তোমার কি হলো? তিনি বললেনঃ তোমার ভাই আবুদ্দারদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু দুনিয়া মুক্ত হয়ে গেছে। তারপর আবুদ্দারদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু এলেন, তিনি তার মেহমানের জন্য খাবার তৈরী করলেন, তারপর তাকে বললেনঃ খাও, তিনি নিজে বললেনঃ আমি রোযা রেখেছি। সালমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেনঃ তুমি না খেলে আমি খাচ্ছিনা। বর্ণনাকারী বলেনঃ তারপর তিনি খেতে বাধ্য হলেন। তারপর যখন রাত হলো আবুদ্দারদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু রাতের নামাজের জন্য দাড়াতে গেলেন, কিন্তু সালমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেনঃ শুয়ে পড়। তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। তারপর আবার উঠতে চাইলেন, কিন্তু সালমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেনঃ ঘুমাও, তারপর যখন রাত্রির শেষাংশ হলো তখন সালমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেনঃ এখন উঠ, তারপর তারা দু’জন নামাজ পড়লেন। তারপর সালমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেনঃ তোমার প্রভূর তোমার উপর হক্ক রয়েছে, তোমার নিজের নাফসের তোমার কাছে হক্ক রয়েছে। তোমার উপর তোমার পরিবারের অধিকার রয়েছে। প্রত্যেক হক্দারকে তার হক প্রদান কর। তারপর আবুদ্দারদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এসে তা জানালে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ “সালমান সত্য বলেছে”। (সহীহ্ বুখারী: ১৯৬৮)
৩) আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আ’স (রাদিয়াল্লাহু আনহুমা) বর্ণিত হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেছিলেনঃ “তুমি রোযাও রাখ, আবার রোযা ভাংবেও, নামাজের জন্য রাতে দাড়াবে আবার ঘুমাবেও; কেননা তোমার উপর তোমার শরীরের হক্ক রয়েছে, তোমার উপর তোমার চোখের হক্ক রয়েছে। তোমার উপর তোমার স্ত্রীর হক্ক রয়েছে”। (সহীহ্ বুখারী: ১৯৭৫)
বিস্তারিত দলীলঃ
১) আনাস বিন মালিক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেনঃ নবী করীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন আমাকে ডাকার সময় বললেনঃ “হে দু’কান ওয়ালা”। বর্ণনাকারী বলেনঃ অর্থাৎ রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাথে হাসি তামাসা সূচক বিনোদনের জন্য একথাটি বলেছিলেন। (তিরমিযী: ১৯৯২)
২) “বৃদ্ধ জান্নাতে যাবেনা”।
৩) রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এক মহিলা আসলে, তিনি বললেন, তোমার স্বামী কে? তিনি বললেনঃ অমুক, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ যার দু’ চোখে সাদা আছে সে? মহিলা চিন্তা করতে করতে তাড়াতাড়ি স্বামীর কাছে গেলে স্বামী তাকে জিজ্ঞাসা করলেনঃ তোমার কি হলো? তখন সে বললঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তোমার দু ’চোখে সাদা আছে, লোকটি তাকে বললঃ তুমি কি দেখনা আমার চোখের কালো অংশের চেয়ে সাদা অংশই বেশী।
৪) আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) বলেনঃ আমি আমার খেলনা মেয়েদের নিয়ে খেলতাম, আমার সাথে আমার কিছু মেয়ে সাথী ছিল যারা আমার সাথে খেলত, যখনি রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার কাছে প্রবেশ করতেন তারা পালিয়ে যেত, কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে আমার কাছে নিয়ে আসতেন। (বুখারী: ৬১০৩)
৫) আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) বলেনঃ কোন এক সফরে আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথী ছিলাম, তিনি আমার সাথে হাটার প্রতিযোগিতা করলেন তাতে আমি তাকে ছাড়িয়ে গেলাম, কিন্তু পরবর্তীতে যখন আমার শরীরে গোস্ত ধারণ করলাম তখন তার সাথে প্রতিযোগিতা করলাম কিন্তু তখন তিনি আমাকে ছাড়িয়ে গেলেন। তারপর তিনি বললেনঃ ”এটা ঐটার বিপরীতে”। (আবু দাউদ: ২৫৭৮)
৬) আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) বলেনঃ আল্লাহর শপথ আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে আমার কক্ষের দরওয়াজায় দাড়ানো দেখেছি, যখন আবিসিনিয়ার লোকগণ আল্লাহর রাসূলের মাসজিদে তাদের যুদ্ধের অস্ত্র নিয়ে খেলছিল। তিনি আমাকে তার চাদর দিয়ে ঢেকে রাখছিলেন যাতে আমি তাদের দিকে তাকাতে পারি। তারপর আমার জন্য অবস্থান করতেই থাকতেন যতক্ষন না আমি নিজে থেকে ফিরে যেতে না চাইতাম। (মুসলিম: ৮৯২)
৭) (খেজুর গাছের উদাহরণ দেয়ার পিছনে মুল শিক্ষা)
৮) ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আরো বলেনঃ “আমি ওয়াজ নসীহত করার জন্য সুনির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করি যেমনিভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা করতেন যাতে করে আমাদের মধ্যে একঘেয়েমির ভাব না আসে)।
সাহাবাদের থেকেও বিনোদনের গুরুত্ব বর্ণিত হয়েছে, যেমনঃ
৯) আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেনঃ “তোমরা এ মনগুলোতে প্রশান্তি দাও, এগুলোর জন্য বিভিন্ন জ্ঞানগর্ভ কথা এনে প্রশস্তি দাও। কেননা শরীরের মত এ গুলোও বিরক্ত হয়”।
১০) ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেনঃ “তোমরা মনগুলোকে আনন্দ দাও; কেননা মন যখন বিরক্ত হয় তখন অন্ধ হয়ে যায়”। (বাহজাতুল মাজালিস, ইবনে আব্দুল বার)
১১) তিনি আরো বলেনঃ ‘নিশ্চয়ই মানব মনের কিছু আকাংখ্যা আছে, আগ্রহ আছে, আবার তাতে রয়েছে বিব্রত অবস্থা, ও পিছুটান। সুতরাং যখন আকাংখ্যা ও আগ্রহ থাকবে তখন তা কাজে লাগাও, আর যখন বিরক্তি ও পিছুটান আসবে তখন কাজ ত্যাগ করবে’।
১২) (হাফসা কতৃক হাবসার এক গীর্জার বর্ণনার উদ্দেশ্য)।
১৩) উমর ইবনে আব্দুল আজীজ বলেনঃ ‘মুসলমান খেলাধুলা, তামাসা, হাসি ঠাট্টা করবে এটা কোন দোষের ব্যাপার নয়। তবে এটা যেন তার অভ্যাস, চরিত্র ও প্রকৃতিতে পরিণত না হয়ে পড়ে। কারণ তখন সে কঠোরতার স্থানে ছাড় দেবে আর কাজের সময় বেহুদা কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়ে পড়বে’।
১৪) তিনি আরো বলেনঃ ‘তোমরা আল্লাহর কিতাব নিয়ে আলোচনা কর, তা নিয়ে বস। যখন তোমরা একঘেয়েমি অনুভব করবে তখন মানুষদের মধ্য থেকে কারো কাহিনী বলবে এটা অত্যন্ত সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য ব্যাপার’।
১৫) আবু সালমা ইবনে আব্দুর রাহমান বলেনঃ “রাসুলুল্লাহর সাহাবীগণ কক্ষনো মরার মত ছিলেননা আবার মুখ ফিরিয়েও বসে থাকতেননা, তারা তাদের মজলিসে কবিতা রচনা করতেন, জাহেলিয়াতের বিভিন্ন কাহিনী বর্ণনা করতেন, কিন্তু যখন তাদের কাছে দ্বীনের কোন কিছু চাওয়া হতো তখন তা আদায়ের জন্য তাদের চক্ষু রক্তিম বর্ণ হয়ে যেত’।
ঙ) ইসলামে বিনোদনের বিশেষত্ব
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। আকীদা ও শরীয়ত উভয়েরই নাম। এ দুটি থেকেই ইসলামের যাবতীয় মুলনীতি, আচার আচরণ, ব্যবহারবিধি নির্দিষ্ট হওয়া উচিত। তাই ইসলামে বিনোদনের কি কি বিশেষত্ব রয়েছে তার কিছু বর্ণনা দেয়া প্রয়োজন। যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছেঃ
১) বিনোদন ইসলামে আল্লাহর ইবাদত হিসাবে গণ্য হতে পারেঃ আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “বলুন আমার নামাজ, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ একমাত্র রাব্বুল আলামীন আল্লাহর জন্য”। আর নিঃসন্দেহে বিনোদন একজন মুসলিমের জীবনের একটা আংশ। সুতরাং তা ইবাদত থেকে খালি হতে পারেনা। যদি বান্দা তার নিয়্যতকে পরিশুদ্ধ করে এবং শরীয়ত গর্হিত কোন কাজ না করে। কেননা এর মাধ্যমে বান্দা তার বাস্তব কাজ যথা আল্লাহর অন্যান্য প্রধান নেক কাজ করার জন্য উৎসাহ-উদ্দীপনা লাভ করে।
আবুদ্দারদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেনঃ আমি কখনো কখনো সামান্য খেলাধুলা জাতীয় বিষয়ের দিকে ঝুকে পড়ি যাতে করে তা আমার জন্য পরবর্তীতে সঠিক কাজ করার জন্য প্রেরণা যোগাতে পারে।
২) ইসলাম বিনোদনের মৌলিক বিষয় সমূহ সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছে, কিন্তু মাধ্যম সমূহ পরিবর্তনের অনুমতি দিয়েছেঃ
সুতরাং যে যে মৌলিক নীতিমালা বেঁধে দিয়েছে সেগুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখা একান্ত কর্তব্য। এর বাইরে কিভাবে পদ্ধতি ও মাধ্যম নির্ধারনের ক্ষেত্রে তার পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে।
৩) ইসলাম মানব প্রকৃতির স্বাভাবিক দিকের প্রতি নজর দিয়েছেঃ
যখন আমরা শরীয়ত সমর্থিত বিনোদনগুলোর দিকে তাকাই তখন দেখতে পাই, সেগুলো মানুষের যাবতীয় চাহিদা তথা মানষিক, দৈহিক, আত্মিক সব রকম চাহিদা মিটিয়েছে। এটা এ কথাই প্রমাণ করে যে, ইসলামের বিনোদন পদ্ধতি মানব প্রকৃতির অনুকূল।
৪) ইসলামের বিনোদন পদ্ধতি মানব জীবনের বিভিন্ন অংশের ভারসাম্য রক্ষা করেঃ
মানুষের জীবনের বিভিন্ন দিক রয়েছে, যেমনঃ আত্মা, শরীর, বিবেক। আবার তার বিভিন্ন প্রকার ঝোঁক ও রয়েছে। এগুলো সঠিক ও সমভাবে পূর্ণ না হলে তার জীবনে বিশৃংখলা দেখা দেয়। ইসলাম সমর্থিত বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ড মানুষকে এ অবস্থা থেকে মুক্তি দেয়।
৫) বিনোদনের জন্য ইসলাম অবসর সময়কে নির্ধারণ করেছেঃ
সবচেয়ে বড় কথা হলো ইসলাম বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ডকে বাস্তব কর্মকাণ্ডের উপর প্রাধান্য দেয়না। সুতরাং ওয়াজিব ইবাদাত, চাকুরী, খাওয়া এবং ঘুম অনুরূপভাবে আত্মীয় স্বজনের দেখাশুনা, মেহমানদারী, রুগীর সেবা শূশ্রষা ইত্যাদির উপর বিনোদন প্রাধান্য পাবেনা।
চ) ইসলামে বিনোদনের স্থায়ী নিয়মনীতি
১) বিনোদনের মুল হলো জায়েয হওয়াঃ এর প্রমাণ আবুদ্দারদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বর্ণিত হাদীস, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “আল্লাহ তাঁর কিতাবে যা হালাল করেছেন তা হালাল, আর যা হারাম করেছেন তা হারাম। আর যে সমস্ত ব্যাপারে তিনি চুপ থেকেছেন তাতে রয়েছে ছাড়। সুতরাং তোমরা তার ছাড় গ্রহণ কর। কেননা আল্লাহ্ কোন কিছু ভোলেননা”। তারপর তিনি এ আয়াত পাঠ করলেনঃ “আর আর প্রভু ভুলে যাননা”। (মুস্তাদরাকে হাকেম: ২/৩৭৫)
অনুরূপভাবে শরীয়তের সুনির্দিষ্ট ধারাগুলোর মধ্যে একটি বড় ধারা হলোঃ “সাধারণ ব্যাপারে যতক্ষণ পর্যন্ত কোন বিষয়ে হারাম হওয়ার দলীল না পাওয়া যাবে ততক্ষন পর্যন্ত তা হালাল”। (আল-আশবাহ্ ওয়ান্-নাজায়ের, সুয়ূতী: পৃ-৬০)
২) বিনোদন হলো মাধ্যম তা উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য নয়ঃ
বিনোদন মানব জীবনের বিভিন্ন অংশের ভারসাম্য আনয়নের মাধ্যম। কোন এক দিকের ভারসাম্যতা ক্ষুন্ন হলে বিনোদনের মাধ্যমে সে অংশের পরিপূর্ণতা লাভের জন্য প্রচেষ্টা চালাতে হয়। কিন্তু যদি এ সীমা লঙ্গন করা হয়, এবং বিনোদনই লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যে পরিণত হয়ে যায় তখন তার হুকুম মাকরূহ বা হারামে পরিণত হয়।
এর দ্বারা আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, কোন কোন বিনোদন যখন পেশায় পরিণত হয় তখন তা হালাল বা বৈধতা থেকে হারাম বা মাকরুহের পর্যায়ে পৌছে যায়।
কেননা তা ইসলামের সুনির্দিষ্ট শিক্ষা থেকে দুরে সরিয়ে দেয়। ইসলাম চায়না কিছু মানুষ ইসলামের পরিচালনা ছেড়ে ভারসাম্যহীন জীবন যাপন করে উম্মতকে দুর্বল করে তুলে। তদুপরি এতে করে ইসলামের দুশমনগণ ঈমানদারদেরকে তাদের মুল কর্মকাণ্ড থেকে দুরে রেখে হয় তাদের পদলেহী বানাবে নতুবা এর মাধ্যমে তারা তাদের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে সহযোগীতা করবে।
৩) বাস্তব কর্মকাণ্ড হলো মুখ্য বিষয়, পক্ষান্তরে বিনোদনমুলক কর্মকাণ্ড গৌণ বিষয়ঃ
সুতরাং;
ক) যখন কোন বাস্তব কর্মকান্ডের সাথে বিনোদনমুলক কর্মকান্ডের বিরোধিতা হয় তখন বাস্তব কর্মকাণ্ড অগ্রাধিকার পাবেঃ আবু বারযাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেনঃ “রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এশার পূর্বে ঘুমানো এবং তার পরে অকারণ জাগ্রত থেকে গল্পগুজব করা পছন্দ করতেননা” (সহীহ্ আল-বুখারী: ৫৯৯)। কারণ নামাজ পড়া ফরজ, আর গল্প করা বিনোদনের অংশ। তাই গল্পের কারণে যাতে নামাজের ক্ষতি না হয় সেদিকে গুরুত্ব দিয়েছেন।
খ) বিনোদনমুলক কর্মকান্ডে অবশ্যই শরীয়ত বিরোধিতা বর্জন করতে হবেঃ
এ নীতিটি সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণঃ এর কিছু নমুনা নিম্নে পেশ করা গেলঃ
১• সরাসরি বিনোদনের সাথে সম্পৃক্ত শরীয়ত বিরোধী কিছু কর্মকাণ্ডঃ
- এমন বিনোদন না করা যাতে অন্যের প্রতি ঠাট্টা-বিদ্রুপ আছে• বা তাদের প্রতি ভয় প্রদর্শন করা হয়, বা কারো সম্পদ নষ্ট করা হয়। কারণ আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “হে ঈমানদারগণ! কোন জাতি যেন অপর জাতি নিয়ে উপহাস না করে কেননা যাকে উপহাস করা হয় সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং কোন নারী অপর নারীকেও যেন উপহাস না করে; কেননা যাকে উপহাস করা হয় সে উপহাসকারিণী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করোনা, এবং তোমরা একে অপরকে মন্দ নামে ডেকোনা; ঈমানের পরে মন্দ নামে ডাকা গর্হিত কাজ। যারা এ ধরনের আচরণ তাওবা করবেনা তারাই যালিম”। (সূরা আল-হুজরাত: ১১) রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ “তোমাদের কেউ যেন তার ভাইয়ের সম্পদ খেলাধুলার চলে বা ইচ্ছা করে না নেয়, যে কেউ তার ভাইয়ের লাঠি নিল সে যেন তা ফেরত দেয়”। (সুনানে আবু দাউদ: ৫০০৩) তিনি আরও বলেনঃ “কোন মুসলিমই অপর মুসলিমকে ভয় দেখানো উচিত নয়”। (আবু দাউদ, কিতাবুল আদাব, হাদীস নং: ৫০০-)
- এমন বিনোদন না করা যাতে অপর ভাইকে কথায় বা কাজে, শারিরীক বা আর্থিক অথবা মানসিকভাবে কষ্ট দেয়া হয়ঃ আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “যারা মুমীন পুরুষ ও মুমীন নারীকে কোন অপরাধ না করলেও পীড়া দেয়, তারা অপবাদ ও স্পষ্ট গুনাহর বোঝা বহন করল”। (সূরা আহযাব: ৫৮) অনুরূপভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “মুসলিম হলো ঐ ব্যক্তি যার হাত ও জিহবা থেকে মুসলিমগণ নিরাপদ থাকলো”। (বুখারী, মুসলিম)
- এমন বিনোদন পরিত্যাগ করতে হবে যাতে মিথ্যাচার এবং অপবাদ রয়েছেঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “ঐ লোকের ধ্বংশ হোক যে ব্যক্তি লোক হাসানোর জন্য মিথ্যা বলে, তার ধ্বংশ হোক, তার ধ্বংশ হোক”। (মুসনাদে আহমাদ: ৫/৫, সনদটি হাসান)
- এমন বিনোদ না করা যাতে খুব বেশী হাসতে হয়, কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “আর তোমরা বেশী বেশী হাসবেনা; কেননা তা মনকে মৃত্যু দেয়”। (মুসনাদে আহমাদ: ২/৩১০, সনদটি সহীহ্)
- এমন বিনোদন যেন না হয় যাতে রয়েছে গান বাজনাঃ কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “আমার উম্মাতের মধ্যে কিছু লোক এমন হবে যারা ব্যভিচার, রেশমী (সিল্ক), মদ ও গান বাদ্য হালাল করতে চাইবে”। (সহীহ্ আল-বুখারী: ৫৫৯০)
- এমন বিনোদন না করা যাতে জীবিত কোন প্রাণীকে নিশানা বানানো হয়; কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “তোমরা জীবন্ত প্রাণীকে নিশানা বানিওনা”। (সহীহ্ মুসলিম: ১৯৫৭)
- বিনা কারণে প্রাণীর ছবি তোলার মত বিনোদন যেন না হয়। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে কেউ দুনিয়াতে কোন ছবি বানালো কিয়ামতের দিন তাকে সে ছবিতে রূহ দেয়ার নির্দেশ দেয়া হবে অথচ সে তা করতে পারবেনা ”। (সহীহ্ বুখারী: ৫৯৬৩)
- এমন কোন বিনোদন না করা যাতে চতুষ্পদ জন্তুদের মধ্যে লড়াই সৃষ্টি করতে হয়। কারণ ইবনে আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম জন্তুদের মধ্যে লড়াই বাধাতে নিষেধ করেছেন”। (তিরমিযী: ১৭০৮, ১৭০৯)
- এমন প্রতিযোগীতা না করা যাতে সরাসরি হারাম যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে হয়ঃ যেমন দাবা, কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি দাবা খেলল সে যেন শুকরের গোস্তে হাত ডুবাল”। (সহীহ্ মুসলিম: ২২৬০) ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু যখন কাউকে দাবা খেলতে দেখতেন তখনি তা ভেঙ্গে দিতেন। (মুয়াত্তা মালিক: পৃ-৬৮২) অনুরূপভাবে জুয়া, কারণ আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “হে ঈমানদারগণ! অবশ্যই মদ, জুয়া, মূর্তি, লটারীর তীর, এসব কেবল অপবিত্র বিষয়, শয়তানের কাজ, সুতরাং তোমরা তা ত্যাগ কর। যেন তোমরা সফলতা লাভ করতে পার”। (সূরা আল-মায়িদাহ্: ৯০)
২• বিনোদনে অংশগ্রহণকারীদের সাথে সম্পৃক্ত নীতিমালাঃ তম্মধ্যে রয়েছেঃ
- যাদের সাথে বিনোদনে অংশ গ্রহণ করতে যাচ্ছে তারা যে ভালো এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হওয়াঃ কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “একজন মানুষকে তার বন্ধুর মতাদর্শে দীক্ষিত বলে গণ্য করা হবে; সুতরাং তোমাদের প্রত্যেকে যেন দেখে নেয় সে কাদের সাথে বন্ধুত্ব পাতছে”। (আবু দাউদ: ২/২৯৩, হাদীসটির সনদ হাসান)
- বিনোদন যেন বিনোদনে অংশগ্রহণকারীর জন্য ক্ষতির কারণ না হয়। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “কোন ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া যাবেনা, ক্ষতিগ্রস্থ করা যাবেনা”। (আহমাদ: ১/৩১৩) অনুরূপভাবে ইসলামী শরীয়তের স্থিরিকৃত নীতিমালার মধ্যে রয়েছেঃ ‘যখন হারাম ও হালাল একত্রিত হয়, তখন হারাম প্রাধান্য পাবে’। অনুরূপভাবে আরেকটি নীতি হলোঃ ‘ক্ষতিগ্রস্থতা দুর করা স্বার্থ হাসিলের উপর প্রাধাণ্য পাবে’।
- মহিলা-পুরুষের যেন মেলা মেশা না হয়ঃ কারণ আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “আপনি ঈমানদারদের বলুনঃ তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করে, এটাই তাদের জন্য উত্তম; তারা যা করে সে বিষয়ে আল্লাহ জানেন”* আর আপনি ঈমানদার নারীদের বলুনঃ তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাজত করে, তারা যেন যা সাধারণতঃ প্রকাশ পায় তা ব্যতীত তাদের আভরণ (অলংকার,আকর্ষণীয় পোষাক) প্রদর্শন না করে, তাদের বুক ও চিবুক দেশ যেন মাথার কাপড় ওড়না দ্বারা আবৃত করে”। (সূরা আন্-নূর: ৩০-৩১) অনুরূপভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “আমার পরে আমি পুরুষের জন্য মহিলাদের ব্যতীত সবচেয়ে ক্ষতিকর ফিৎনা বা পরীক্ষা ও মুসিবতের বিষয় আর কিছুই ছেড়ে যাইনি”। (বুখারী: কিতাবুন্ নিকাহ্) অনুরূপভাবে জারীর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেনঃ “আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে হঠাৎ করে পড়ে যাওয়া দৃষ্টি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি আমাকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে আদেশ করলেন”। (সহীহ্ মুসলিম: ২১৯৫) তদুপরি পুরুষ ও মহিলা প্রত্যেকের জন্য তাদের সার্বিক গতি প্রকৃতি অনুসারে ভিন্ন প্রকৃতির বিনোদনের ব্যাবস্থা ইসলামে রয়েছে। একের বিনোদন অপরের জন্য বিরক্তির কারণ হওয়াটাই স্বাভাবিক।
৩• বিনোদনের সময়ের সাথে সম্পৃক্ত নীতি মালাঃ তম্মধ্যে রয়েছেঃ
- বিনোদন যেন আল্লাহর হক্ক আদায়ের সময়ে না হয়; সুতরাং আল্লাহর হক্ক নষ্ট করে কোন প্রকার বিনোদন করা যাবেনা। যেমন নামাজের সময়ে কোন বিনোদন নেই। তখন নামায আদায় করতে হবে। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “তোমরা সালাত সমূহ এবং মধ্যবর্তী নামাজকে হিফাজত করো, এবং বিনীতভাবে আল্লাহর উদ্দেশ্যে দাড়িয়ে যাও”। (সূরা আল-বাকারাহ্: ২৩৮) অনুরূপভাবে ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত; তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে এক লোক জিজ্ঞাসা করলেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! কোন আমল সবচেয়ে উত্তম? উত্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ নামাজের সময়ে নামাজ আদায় করা, পিতা-মাতার খেদমত করা এবং আল্লাহর রাস্তায় জ্বিহাদ করা”। (বুখারী, কিতাবুত্ তাওহীদ)
- অনুরূপভাবে মানুষের হক্ক আদায় করার সুনির্দিষ্ট সময় থাকলে সে সময়েও বিনোদন করা যাবেনা। কারণ মানুষের হক্ক সুনির্দিষ্ট সময়ে আদায় না করা হারাম।
- সমস্ত সময় শুধুমাত্র বিনোদনের জন্য ব্যয় না করা; কেননা সীমালঙ্গন ও অতিরঞ্জন ও সংকোচন, এ দু’য়ের মাঝামাঝি হলো ইসলাম।
৪• বিনোদনের স্থানের সাথে সম্পৃক্ত কিছু নিয়মনীতিঃ তম্মধ্যে রয়েছেঃ
- বিনোদন স্পটের ক্ষতি না করা, কারণ এ স্থানগুলো সর্ব সাধারণের। যে ব্যক্তি এগুলোর উপর অবৈধ হস্তক্ষেপ করেছে সে সর্ব সাধরনের সম্পত্তির উপর হামলা করল। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “তোমরা লা’নতকারীদের লানত থেকে বেচে থাক, তারা বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! লানত কারী কারা? তিনি বললেনঃ যে মানুষের চলার পথে মলমুত্র ত্যাগ করে, বা তাদের ছায়া দেয় এমন স্থানে মল-মুত্র ত্যাগ করে”। (সহীহ্ মুসলিম, কিতাবুত্ ত্বাহারাহ্)
- বিনোদন স্পটের আশে পাশের অধিবাসীদের ক্ষতি না করা, বা তাদেরকে চাপের মুখে না রাখা। বা বিনোদন স্পটের পাশ দিয়ে গমনকারীদের চলার পথে বাধা না হওয়া। কেননা তাতে তাদেরকে বিনা অপরাধে কষ্ট দেয়া হলো, অথচ আল্লাহ বলেনঃ “যারা মুমীন পুরুষ ও মুমীন নারীকে কোন অপরাধ না করলেও পীড়া দেয়, তারা অপবাদ ও স্পষ্ট গুনাহর বোঝা বহন করল”। (সূরা আহযাব: ৫৮) অনুরূপভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি এটা পছন্দ করে যে সে জাহান্নাম থেকে দূরে থাকবে, জান্নাতে প্রবেশ করবে, তাহলে আল্লাহ ও আখেরাত দিনের উপর ঈমান রাখা অবস্থায় যেন তার মৃত্যু হয়, এবং মানুষের কাছে এমনভাবে আসুক যেভাবে আসাটা মানুষ পছন্দ করে।
- বিনোদনের জন্য সুনির্দিষ্ট স্থানে গমন করা, কেননা সব বিনোদনের জন্য সব স্থান গ্রহণযোগ্য নয়।
৫• বিনোদনের পোষাকের সাথে সম্পৃক্ত কিছু নীতিমালাঃ
- শরীয়ত যেভাবে পোষাক নির্ধারণ করে দিয়েছে তার বাইরে না যাওয়া। সুতরাং কোন মহিলার পোষাক কোন পুরুষ পরতে পারবেনা, অনুরূপভাবে কোন পুরুষের পোষাক কোন মহিলা পরতে পারবেনা। কারণ রাসুল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “আল্লাহ তা’আলা পুরুষের বেশধারী মহিলাকে, আর মহিলার বেশধারী পুরুষকে লানত করেছেন”। (হাদীস)
- মহিলা তার জন্য সুনির্দিষ্ট সতর ঢেকে রাখবে, অনুরূপভাবে পুরুষ তার সুনির্দিষ্ট সতর ঢাকবে।
- কাফেরদের সুনির্দিষ্ট বেশভূষা গ্রহণ করবেনা। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি কোন জাতির মত হতে চাইবে সে তাদের মধ্যে গণ্য হবে”। (সুনানে আবু দাউদ, কিতাবুল্ লিবাস)
ছ) রাসূলের যুগের বিনোদনের স্বরূপঃ
॥ রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগে বিনোদন ছিল, এবং তার কিছু লক্ষ্য ও ছিলঃ তম্মধ্যেঃ
১• সমাজের প্রত্যেককে জ্বিহাদের জন্য প্রস্তুত করা। যেমন ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা, ধরাধরি, তীর নিক্ষেপ ইত্যাদীর মাধ্যমে তাদের তৈরী কর। সে উদ্দেশ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও ঘোড় দৌড়ে অংশগ্রহণ করেছিলেন, ইবনে উমর তার সাথে প্রতিযোগিতা করেছিলেন। (সহীহ্ মুসলিম)
২• মুসলিম সমাজের সবাইকে একে অপরের ভালবাসার উপর তৈরী করা, কাছে টেনে আনা। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদল সাহাবার পাশ দিয়ে গেলেন যারা তীরন্দাযী করছিল, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে বললেনঃ হে ইসমাঈলের বংশধর তোমরা তীরন্দাযী কর; কেননা তোমাদের পিতা তীরন্দায ছিলেন। তোমরা তীরন্দাযী কর, আমি অমুক গ্রুপের সাথে, অন্য গ্রুপ তিরন্দাযী করা ছেড়ে দিলে রাসুল কারণ জানতে চাইলে তারা বলল, আপনি যে তাদের মাঝে? তিনি বললেনঃ তীর নিক্ষেপ কর, আমি তোমাদের সবার সাথে”। (সহীহ্ বুখারী)
৩• পারিবারিক জীবনে শান্তি ও ভালবাসার প্রসার ঘটানো, যার প্রমাণ আমরা দেখি, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার স্ত্রী আয়েশার সাথে প্রতিযোগিতার করার মাধ্যমে। অন্য এক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “প্রত্যেক খেলাই বাজে কাজ। তবে কেউ তার তীর নিয়ে তীরন্দাযী শিখে, তার ঘোড়াকে শিক্ষা দিবে অথবা নিজের স্ত্রীর খেলাধুলা করবে; কেননা এগুলো হক্ক বা বাস্তব কাজ”। (সুনানে দারমী, কিতাবুল জিহাদ)
৪• শারিরীক ও মানষিক ভাবে শক্তিশালী করে তৈরী করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ “দূর্বল মু’মিনের চেয়ে শক্তিশালী আল্লাহর কাছে মু’মিন অনেক উত্তম ও অধিক প্রিয়, সবার মধ্যেই কল্যান রয়েছে•••”। (সহীহ্ মুসলিম, কিতাবুল ক্বাদর)
৫• দ্বীনের মধ্যে প্রশস্তি আছে, তাতে রয়েছে মানুষের বিকাশের সুযোগ এটা প্রমাণ করার জন্য। এর প্রমাণ পাই আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার স্ত্রী আয়েশার খেলনা কন্যা ও তার মেয়ে সাথীদের খেলার সুযোগ করে দেয়ার মধ্যে। কারণ রাসুল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন বলেছিলেনঃ “যাতে করে ইহুদীরা এটা জানতে পারে যে, আমাদের দ্বীনের মধ্যে কোন প্রকার প্রশস্তি রয়েছে, আমি প্রশস্ত সরল দ্বীন নিয়ে প্রেরিত হয়েছি”।
৬• মানুষের মনে যে সমস্ত চিন্তা ভাবনা, টেনশন ইত্যাদির উদ্রেক হয় সেগুলো দূর করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ “কোন মানুষের মনে চিন্তা আসলে তার তরবারীটা পরে তার চিন্তা দূর করাতে কোন সমস্যা নেই”। (মু’জ্জামুচ্চাগীর, তাবারানী: ২/২৭৫)
॥ রাসূলের যুগের বিনোদনের কিছু নমুনা ও উদাহরণঃ
১• হাটার প্রতিযোগিতাঃ
- রাসূল এবং আয়েশার মধ্যে প্রতিযোগিতা।
- উবায়দুল্লাহ ও আব্দুল্লাহ সহ আব্বাসের ছেলেদের রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেনঃ “যে আমার কাছে আগে আসতে পারবে তাকে এত এত দেয়া হবে”। (মুসনাদে আহমাদ: ১/২১৪) এভাবে তার প্রতিযোগিতা করতেন।
- সাহাবাদের মধ্যে হাটার প্রতিযোগিতা খুব নৈত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল, যেমন সালামা ইবনে আক’ওয়া(রাদিয়াল্লাহু আনহু)র ঘটনা। (সহীহ্ মুসলিম, কিতাবুল জিহাদ ওয়াচছিয়ার) আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর ও উমার (রাদিয়াল্লাহু আনহুমা)র মাঝে প্রতিযোগিতার ঘটনা । (সুনানুল কুবরা লিল বাইহাকী: ১০/২৯)
২• ঘোড় দৌড় ও তার প্রতিযোগিতাঃ
- রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে সে ঘোড় দৌড়ের ব্যবস্থা করতেন, তাতে অংশ নিতেন। (সহীহ্ মুসলিম, কিতাবুল ইমারাত) এমনকি প্রতিযোগীকে পুরস্কারও দিতেন। (মুসনাদে আহমাদ: ২/৯১)
- অনুরূপভাবে উটের প্রতিযোগিতাও হত, তাতে রাসূল নিজেও অংশ নিতেন। (সহীহ্ বুখারী, কিতাবুর্ রিকাক, বাবুত্তাওয়াদু)
৩• ধরাশায়ী করাঃ
- রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও রোকানাকে ধরাশায়ী করেছিলেন। (সুনানে আবু দাউদ, কিতাবুল লিবাস)
- এ ছাড়াও রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো অনেককে ধরাশায়ী করেছিলেন। (মুসনাদে আবু ইয়’লা)
- অনুরূপভাবে অহুদ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য দু’ তরুন সাহাবীর এ ধরাশায়ী করায় প্রবৃত্ত হওয়া।
৪• ভার বহন করাঃ
- ইবনে কাইয়েম উল্লেখ করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছু যুবককে ভার বহন করে শক্তিশালী হতে দেখে নিষেধ করেননি। (আল-ফুরূসিয়্যাহ্: ৩৭)
৫. তীরন্দাযী করাঃ
- এ ব্যাপারে পূর্বেই কিছু হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে।
৬• সাঁতার কাটাঃ
- এ ব্যাপারে দুর্বল হাদীস রয়েছে।
- উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে অনেক বাণী এসেছে।
- সাতার কাটার দ্বারা শরীর পুষ্ট হয়।
৭• বাচ্ছাদের খেলনাঃ যেমনঃ
- দোলনা জাতীয় খেলা।
- বাচ্ছাদের বানানো খেলা।
লেখক পরিচিতি:
ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
এম এম (ঢাকা), লিসান্স, মাষ্টার্স, পি-এইচ.ডি. (মদীনা, সউদী আরব)
সহকারী অধ্যাপক, আল-ফিক্হ বিভাগ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
0 comments:
Thanks for Comment