জাতীয় স্বার্থে সোচ্চার হতে শেখায় ব্লগ: জানা

বাংলা ব্লগিংয়ের শক্তি ও সম্ভাবনাকে আরও নিবিড়ভাবে বিস্তৃত করতে গত দুবছর যাবৎ বাংলা ব্লগ দিবস পালিত হয়ে আসছে। ২০০৫ সালের এ মাসে বাংলা কমিউনিটি ব্লগের যাত্রা শুরু। এ অবদান এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতকে সামনে রেখে ২০০৯ সালের ১৯ ডিসেম্বর প্রথমবার পালিত হয় বাংলা ব্লগ দিবস। এবছরও ১৯ ডিসেম্বর (সোমবার) বিকেল পাচটায় পাবলিক লাইব্রেরিতে তৃতীয় বাংলা ব্লগ দিবস অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। 

এ আয়োজনের অন্যতম  উদ্যোক্তা সামহোয়্যার ইন ব্লগ। বাংলাদেশে বাংলা ব্লগের পথিকৃৎ বলা হয় সামহোয়্যার ইন ব্লগকে। বাংলা ব্লগ দিবস উপলক্ষে সামহোয়্যার ইন ব্লগের হেড অব অ্যালিয়েন্সেস সৈয়দা গুলশান ফেরদোস জানার সাথে ব্লগ কমিউনিটির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন বাংলানিউজের ব্লগ এডিটর শেরিফ আল সায়ার। 

ঠিক কবে ব্লগ শুরুর চিন্তা মাথায় আসে? কেন?

২০০৪ সালের মার্চ মাসের একটি সকালে কাজের ফাঁকে mannfred mann`s earthband এর "somewhere in Africa" গানটি শুনতে শুনতেই মাথায় ‘somewhere in...’ গেঁথে যায়। ভাবনার শুরু হয় সামহোয়্যার ইন থেকেই। ভেবেই বসে ছিলাম না। কাজ শুরু করি পূর্ণ উদ্যোমে। ১ মে ২০০৫; আমাদের স্বপ্নকে সত্যি করে দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়ে গেল সত্যিকারের সামহোয়্যার ইনের পরিকল্পনা। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া, লোকাল কমিউনিটি ইত্যাদি বিষয়গুলো মাথায় রয়েই যায়। 

ব্লগ, মার্কেট প্লেস, সিটিজেন নিউজ, ভ্রমণ সাইট, ইভেন্টস ইত্যাদি নিয়ে দু`জন মিলে নানান পরিকল্পনা চলতে থাকে প্রতিদিন।

২০০৪ এর জুনে আমরা একটি কমিউনিটি ব্লগ প্ল্যাটফর্মের কথা ভাবি এবং সর্বস্তরের বাংলা ভাষাভাষির অংশ গ্রহণের কথা মাথায় রেখে তা বাংলাতেই হবে বলে সিদ্ধান্ত নিই। 

বাংলাদেশে বাংলা ব্লগ তখনও ছিল না। এমনকি এই সম্পর্কে কোনো ধারণাও নেই। এমন পরিস্থিতিতে ব্লগ শুরু করার সাহস কীভাবে পেলেন?

নিঃসন্দেহে সেটা ছিল বেশ কঠিন। প্রথমত: সেই সময় সারা বিশ্বে ইন্টারনেটের জয়জয়কার। সবাই ভার্চুয়াল জগতে লিখে মেধাচর্চা বা মত প্রকাশে ব্যস্ত। যার মাধ্যম ছিল প্রধানত ইংরেজি। আমাদের দেশেও কিছু মানুষ ইংরেজিতে আগে থেকেই ব্লগিং করতেন।

তাতে স্বভাবিকভাবেই ইংরেজিতে যারা দূর্বল তারা মুক্তবুদ্ধি চর্চা থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলেন। আবার ইংরেজিতে পারদর্শীরাও ইন্টারেনেটে বাংলায় লেখার প্ল্যাটফর্ম খুঁজে বেড়াতেন।  

প্রকৃতপক্ষে ‘ব্লগিং’ ধারণাটি তখনও ছোট্ট গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। জনমত তৈরির মূলধারার মাধ্যমগুলোতে যখন দ্বিপাক্ষিক অংশগ্রহণ সম্ভব নয় তখন দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং প্রাত্যহিক জীবনের আলাপচারিতায় সর্বসাধারণের অংশ গ্রহণের গুরুত্বপূর্ণ দিকটি মাথায় রেখে এই বাংলা কমিউনিটি ব্লগিং এর শুরুটা করে দেয় সামহোয়্যার ইন। এ ক্ষেত্রেও সাফল্যের শুরুটা সেই হাতে গোনা ক`জন ব্লগারকে দিয়েই। কেননা আমরা সেই অল্প ক`জন ব্লগারকে খুঁজে নিয়ে তাঁদের সাথে পরিচিয় করিয়ে দিয়েছি এই প্ল্যাটফর্মটিকে। 

কোন রকম বিজ্ঞাপণ ছাড়াই সেই সমস্ত ব্লগারদের প্রবল আগ্রহ, মাতৃভাষার প্রতি ভালবাসা আর আমাদের অসাধারণ টিমটির আন্তরিক প্রচেষ্টায় দ্রুত ছড়িয়ে যেতে থাকলো আজকের `সামহোয়্যার ইন ব্লগ`।         

ব্লগের কাজ শুরু করার পর সমস্যাগুলো কীভাবে সামনে আসছিল? সাড়া কেমন পেলেন?

সাড়া পাওয়ার গল্পটি আগেই বলেছি। আজকে যেমন প্রায় এক লক্ষ ব্লগার তাঁদের সামহোয়্যার ইন ব্লগটিকে ভালোবেসে সমৃদ্ধ করে চলেছেন; বিশ্বময় ছড়িয়ে দিচ্ছেন। এর শুরুটাও হয়েছিল সেই ব্লগারদের দিয়েই। আমরা কেবল বাকস্বাধীনতার একটি উন্মুক্ত মঞ্চের কথা ভেবেছি এবং তা তৈরি করতে সফল হয়েছি।

সমস্যার ক্ষেত্রে প্রথম যে বিষয়টি বেশ জোরালো ছিল তা হলো বাংলা কম্পিউটিং বা অনলাইনে বাংলায় লেখা। বাংলা লেখা সহজ করে তোলার জন্য আমরা শুরু করি ফোনেটিক। তৈরি হয় একটি ভার্চুয়াল কি-বোর্ড যা সাধারণ ব্যবহারকারীদের কাছে জনপ্রিয়। 

পরে ২০০৭ এ ইউনিকোডের জনপ্রিয়তা এবং চাহিদা বিবেচনা করে তা যুক্ত করা হয়।  

এসবকিছুর মূলে একটি বিষয় আমি গৌরবের সঙ্গে বলতে চাই। সেটি হলো সামহোয়্যার ইন ব্লগ তৈরির পেছনের দলটির কথা। অনেক দিন, অনেক রাত অক্লান্ত শ্রম এবং ভালোবাসা দিয়ে যারা একে দাঁড় করিয়েছেন। বিভিন্ন ভার্সন তৈরির আগের রাতটি, বিশেষ উপলক্ষের আগের দিন-রাত এবং সেই সাথে হরতাল বা রাজনৈতিক অস্থিরতায় আমাদের এই দলটি ছোট্ট অফিসে আটকে থেকে প্রবল উৎসাহে এবং নির্মাণে কাজ করে গেছেন। যত্নের সাথে সাজিয়ে তুলেছেন। তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।

বাংলাদেশে ব্লগ সংস্কৃতি বিস্তারে সামুর বড় অবদান আছে। এ বিষয়টিকে আপনারা কীভাবে দেখেন?

এ বিষয়টি নিয়েও কথা বলার দায়িত্ব এবং অধিকার ব্লগারদেরই। আমরা আনন্দিত যে বাংলা ভাষার চর্চা, মত বিনিময় এবং জনমত তৈরির উদ্দেশ্যে আমরা যে যাত্রা শুরু করে দিয়েছি তার রেশ অব্যাহত রয়েছে এবং একটির পর একটি বাংলা ব্লগ প্ল্যাটফর্ম তৈরি হচ্ছে। লেখক তৈরি হচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগের জায়গাটি এখন আর দূরের কিছু নয়। অনেকখানি সহজ এবং গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
  
ব্লগ সংস্কৃতি যেখানে দলাদলিকে গালাগাল করে। সেখানে দেখা যায় ব্লগার/ব্লগগুলোর মধ্যেও দলাদলি চলে আসে। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?

এখানে ভিন্নমত প্রকাশ করছি। ‘ব্লগ সংস্কৃতি’ কোন ভাবেই একে অন্যকে আক্রমণের উদ্দেশ্যে তৈরি বা প্রতিষ্ঠিত নয়; বরং এটি সামাজিক দায়বদ্ধতার বোধ থেকে দ্বিমত বা ভিন্নমত প্রকাশের এবং পারস্পরিক আলোচনা-সমালোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ খোলা মাঠ যেখানে সকলের স্বাধীন বিচরণের অধিকার রয়েছে। 

স্বাধীনতার অপব্যবহারও কেউ কেউ করে থাকেন এবং তার নেতিবাচক ফলাফল দুঃখজনকভাবে অপ্রয়োজনীয়ভাবে দলাদলি তৈরি করে। এই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিস্ট দায়িত্বশীলদের জোরালো আইনী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। 
   
বাংলাদেশে ব্লগের ভবিষ্যত কেমন?

দেখুন, মাত্র ছ`বছর আগে জন্ম নেওয়া একটি কমিউনিটি বাংলা ব্লগ এখন এক লক্ষ সদস্যের একটি গর্বিত পরিবার। ব্লগিং চর্চার মধ্য দিয়েই এই সময়টায় তৈরি হয়েছে অসংখ্য নাগরিক সাংবাদিক, লেখক, সমালোচক, গণসংযোগ এবং সামাজিক যোগাযোগ বিষয়ে গবেষক। 

পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সচেতনতার মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে এদেশের মানুষকে ভাবতে এবং কথা বলতে শিখিয়েছে বাংলা ব্লগ কমিউনিটি। জাতীয় স্বার্থে চোখ খোলা রেখে সোচ্চার হতে উদ্বুদ্ধ করেছে ব্লগ কমিউনিটি। নারীকে তার সম্মানজনক অবস্থানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে কথা বলতে শিখিয়েছে ব্লগ। বিভিন্ন সামাজিক অবক্ষয় রোধে কথা বলে ব্লগার। স্বদেশ, স্বাধীনতা আর ঐতিহ্য নিয়ে আলোচনা করে বর্তমান প্রজন্মের কাছে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে উন্মুখ থাকে এই ব্লগাররাই। বর্তমান ব্লগের পরিসরই বাংলাদেশের ব্লগের ইতিবাচক ভবিষ্যতটি নিশ্চত করে। 

এবার ব্যক্তিগত প্রশ্ন করি। আপনি নিশ্চয় জীবনের শুরুতে ব্লগ নিয়ে কিছু করবেন এটা ভাবেননি। জীবনের শুরুতে কী হতে চেয়েছিলেন। স্বপ্নটার কথা জানতে চাচ্ছি। সে সঙ্গে জীবনের বাঁক যে ব্লগের দিকে নিয়ে আসলো। এ বাঁকগুলো সম্পর্কে আপনার অনুভূতি কী?

মজার ব্যাপার হচ্ছে, ছোটবেলায় টিউব-ওয়েল স্থাপনের দৃশ্য আমাকে বেশ আন্দোলিত করতো। সারাদিন ধরে একটার পর একটা দীর্ঘকায় পাইপ মাটির নীচে পৌঁছে দিয়ে বিশুদ্ধ পানি তোলার ব্যবস্থার মত একটি সাধারণ বিষয় আমাকে আগ্রহী করেছিল শুদ্ধতার জন্য একাগ্রতা। আরেকটু বড় হবার পর ট্রাক, ট্রাক্টর এবং অ্যারোপ্লেনের মত বড় বড় যানবাহন চালাবার স্বপ্ন দেখি। যখন বোধ-বুদ্ধি আর বিবেচনা করার বয়স হলো তখন  বাংলা ভাষা, বাংলা শব্দ-বাক্য, সুর, নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, লালন- এসবই আমার সবসময়কার ভাবনা হয়ে উঠলো। তবে বিশেষ কিছু হয়ে ওঠার স্বপ্ন আমি কখনও দেখিনি এবং  বিশেষ কেউ হয়ে ওঠাও খুব দরকারী বলে আমার মনে হয়না। মাতৃভাষায় সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গাটিকে উন্মুক্ত করতে এবং বিভিন্ন প্রক্ষাপটে তা বিশ্বময় করে তোলার প্রচেষ্টাটুকু চালিয়ে যাবার আনন্দ প্রবলভাবে অনুভব করি।  
   
দেশকে নিয়ে কেমন স্বপ্ন দেখেন? সে স্বপ্নগুলো কী ভার্চুয়াল জগত দিয়ে পূরণ সম্ভব?

স্বপ্ন দেখিনা; বরং একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে সামাজিক মূল্যবোধ মাথায় রেখে দেশ এবং দেশের সর্বসাধারণের অধিকার এবং স্বার্থ রক্ষায় মঙ্গলময় ও কার্যকরী পদক্ষেপ দেখতে চাই রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছ থেকে।  

সবার জন্য নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর জীবনের নিশ্চয়তা চাই। দেশ এবং দেশের স্বাধীনতা বিরোধতাকারীদের উপযুক্ত শাস্তি চাই। আমার এইসব চাওয়া ভার্চুয়াল জগৎ দ্বারা সরাসরি পূরণ সম্ভব নয়, তবে তা পূরণ করার পথ তৈরি এবং প্রশস্ত করতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখে আসছে এবং তা ক্রমশ জোরালো হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। 

বাংলানিউজ

0 comments:

Thanks for Comment

Copyright © 2013 MEDIA INFO