ফিরে দেখা কারবালার ইতিহাস
হযরত ইবনে আব্বাস (রা) এর মা উম্মুল ফজল (রা) একদিন এসে রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আজ রাতে স্বপ্ন দেখেছি, আপনার শরীর থেকে একটুকরা গোশত খসে পড়েছে আর আমি তা আপনার হাতে তুলে দিয়েছি। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হেসে দিয়ে বললেন, ফাতেমার ঘরে অতিসত্বর একটি সন্তান ভূমিষ্ঠ হবে। হযরত ফাতেমা (রা) তখন সন্তানসম্ভবা ছিলেন।
এভাবে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে স্বপ্নের তা’বীর বলে দিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই হযরত হুসাইন (রা) ভূমিষ্ঠ হন। উম্মুল ফজল (রা) হুসাইনকে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কোলে তুলে দিলেন। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি যে স্বপ্ন দেখেছিলে সে স্বপ্ন বাস্তবায়িত হলো। হযরত উম্মুল ফজল (রা) বলেন, আমি যখন হুসাইন (রা) কে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর কোলে তুলে দিলাম তখন দেখলাম, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর চোখ দিয়ে দরদর করে পানি ঝরছে। উম্মুল ফজল (রা) বলেন, আমি নবীজীকে জিজ্ঞাসা করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি কাঁদছেন কেন? তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এই মাত্র জিবরাইল (আ) এসে আমাকে বললেন, আপনি এই সন্তানক স্নেহ করছেন; অথচ আপনার উম্মতভক্ত কিছু লোকই তাকে শহীদ করবে। বায়হাকী, মেশকাত ২/৫৭২ এ কথা শুনে আমার চোখ দিয়ে দরদর করে পানি ঝরছে। বোঝা গেল হযরত হুসাইন (রা) এর শাহাদাতের ব্যথা নবীজী সা. জীবদ্দশায়ই অনুভব করে গিয়েছিলেন।
রক্তাক্ত কারবালায় রাসূলে আকরাম
মিশকাত শরীফে উল্লেখ রয়েছে, ইবনে আব্বাস রা. বলেন, আমি আশুরার দিন দুপুরে শুয়ে ছিলাম। হঠাৎ দেখি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অত্যন্ত শোকাহত, তার চুলগুলো উসকো খুসকো। এমতাবস্থায় একটি রক্তভরা শিশি নিয়ে তিনি উপস্থিত। আমি জিজ্ঞেস করলাম ইয়া রাসূল্লাল্লাহ! এই রক্ত কিসের? নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এইমাত্র হুসাইন এবং তার সাথীদের রক্ত কারবালার মাটিতে পড়েছে, আমি উঠিয়ে নিয়ে এসেছি। ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, এরপর আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। আমি তারিখটা স্মরণ রাখলাম। পরে জানতে পারলাম, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সময় রক্তের শিশি হাতে নিয়ে আমার সামনে এসেছিলেন, ঠিক সেই সময় হযরত হুসাইন (রা) কারবালায় শাহাদত বরণ করেছেন। হুসাইন (রা) এর শাহাদাতের ব্যথা কিয়ামত পর্যন্ত অনাগত উম্মতের জন্য ব্যথা এবং বেদনার। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার আলমে বরযখের জীবনে পর্যন্ত এই ব্যথা অনুভব করেছেন।
একটি নাজুক বিষয়
একটি নাজুক বিষয়
হযরত হুসাইন (রা) এর শাহাদাতের ঘটনা একটি স্পর্শকাতর বিষয়, কঠিন বিষয়। বুঝমান মুসলমানদের বোঝার বিষয়। হযরত হুসাইন (রা) এর কথা মনে পরলেই ইয়াজিদের কথা মনে পড়ে, ইয়াজিদ কতো বড় পাষণ্ড ছিল! নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বংশের ৭২ জন মানুষকে তার নির্দেশে নির্মমভাবে শহীদ করা হলো। এমন কোনো মুসলমান কি আছে যে ইয়াজিদের প্রতি তার ক্ষোভ নেই। ইয়াজিদ সম্পর্কে ইমামগণের মত হলো সে ফাসেক ছিল কাফের নয়। বড় নাফরমান ছিল। অনেক বড় অপরাধি ছিল কিন্তু কাফের বলা যাবে না।
ইয়াজিদের খেলাফতের বায়াত
হযরত আমিরে মুয়াবিয়া রা. মৃত্যুর পূর্বেই কাগজের মধ্যে অঙ্গীকারনামা লিখেছেন, আমার স্থলাভিষিক্ত করেছি এজিদকে তোমরা তাকে মেনে নাও। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস, আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের হযরত হুসাইন (রা) এবং আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) এ সকল গুরুত্বপূর্ণ ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ইয়াজিদের খেলাফতের প্রতি সমর্থন প্রদান থেকে বিরত থাকেন। হযরত মুয়াবিয়া (রা) তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের কঠোরতা আরোপ করেননি।
খেলাফতের আসনে ইয়াজিদ
খলিফার আসনে বসেই ইয়াজিদ পূর্ববর্তী প্রাদেশিক গভর্নরদের পদচ্যুতির ফরমান পাঠায়। তার সময় কতো লোক যে ভাগ্যবান হয়েছে আর কতো লোক যে ভাগ্যাহত হয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
মদীনার গভর্নরের প্রতি ইয়াজিদের ফরমান
তদানীন্তন মদীনার গভর্নর ছিলেন ওলীদ ইবনে ওকবাহ ইবনে আবি সুফিয়ান। আবু সুফিয়ানের নাতি আর মক্কার গভর্নর ছিলেন আমর ইবনে সাঈদ ইবনে যায়েদ ইবনে নুফায়েল। ইয়াজিদ খলীফা হয়েই মদীনার গভর্নর ওলিদের নিকট উক্ত চারজনের খেলাফত অস্বীকৃতির বিষয়ে ফরমান লিখল। প্রেরিত দু’টি চিঠির প্রথমটিতে লেখা ছিল আমার আব্বা আমীরে মুয়াবিয়া আল্লাহর দরবারে চলে গেছেন। এটি আল্লাহর দুনিয়াবী শাস্তি যে, তুই হুসাইনের মাথায় কাঠি দ্বারা যে গোস্তাখি করেছিলি শাস্তি তোকে দুনিয়াতেই দেয়া হলো।
হযরত হুসাইনের মাজার
হুসাইন রা. এর মাজার নিয়ে যথেষ্ঠ মত পার্থক্য রয়েছে। মিশরের একটি মসজিদের নাম রাখা হয় মসজিদে তাজ। তাদের মতে হুসাইনের (রা) মাথা মুবারক এখানেই সমাহিত করা হয়। অনেকে বলেন কুফায় দান করা হয়েছে। আল্লাহই এ ব্যাপারে সর্বজ্ঞ। মাথা আর দেহ যাই হোক না কেন তার এই আত্মত্যাগের কথা অবিস্মরণীয় থাকবে। ইতিহাসের পাতায় দেখুন যেখানে সকলেই ইয়াজিদের স্বৈর-শাসনের বিষয়টি এড়িয়ে গেলেন, সেখানে হুসাইন (রা) এই বিশাল চ্যালেঞ্জকে জীবনের বিনিময়ে মোকাবিলা করে এক অনবদ্য ইতিহাস রচনা করেছেন।
0 comments:
Thanks for Comment