সাফল্যের জন্য চাই নিজের ওপর আস্থা : শেরিল স্যান্ডবার্গ

শেরিল স্যান্ডবার্গ ফেসবুকের চিফ অপারেটিং অফিসার।
শেরিল ১৯৬৯ সালের ২৮ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে জন্মগ্রহণ করেন। উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এ বক্তব্যটি তিনি বার্নার্ড কলেজের সমাবর্তনে প্রদান করেন ২০১১ সালের ১৭ মে।


ধন্যবাদ এবং অনেক অনেক অভিনন্দন সবাইকে।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক করে বেরিয়েছি প্রায় ২০ বছর হলো। আমার কাজের জায়গাটি অবশ্য আমার প্রতিটি দিনকে মনে করিয়ে দেয়। আর এটি যেন আমাকে অনেক বেশি বুড়ো বানিয়ে দিয়েছে। মার্ক জুকেরবার্গ একদিন বলছিলেন, ‘শেরিল, মধ্যবসয়ী সংকটগুলো কবে নাগাদ দেখা দেয় বলো তো? তোমার যখন বয়স ৩০ পেরিয়েছে তখন? আসলেই অনেক বয়স তো হয়ে গেল, আর এ জীবনটাতে এমন সব দিনলিপিতে ভরে গেছে, যেগুলো আমি মনেও রাখিনি। আজকের দিনটি অবশ্য ভুলে যাওয়ার নয়, তোমাদের হয়তো মনেও থাকবে না, আমি কী বলে গেলাম। সমাবর্তনের এই বক্তার নামও হয়তো মনে থাকবে না।
আজ এই যে তোমরা নিউইয়র্কের বার্নার্ড কলেজ ছেড়ে যাচ্ছ, তোমরা কি শুধু এখান থেকে অর্জিত শিক্ষাকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছ? না, তোমরা পৃথিবীর অন্যতম একজন সৌভাগ্যবান হিসেবেও এ ক্যাম্পাস ছেড়ে পেশাজীবনে প্রবেশ করছ। তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো এমন পরিবার থেকে এসেছ, যেখানে শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়, কেউ কেউ এমনও আছো, যারা অনেক লড়াই করে আজকে এখানে আসতে পেরেছ, কেউ হয়তো তাদের পরিবারের মধ্যে প্রথম স্নাতক। কী অসাধারণ অর্জন এটি, তাই না? তোমরা যেভাবেই শিক্ষাজীবন শুরু করো না কেন, আজ তোমরা সবাই বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত স্নাতকদের দলে। এমনটা বলছি কারণ, তোমাদের সামনে রয়েছে অপার সম্ভাবনা। তাই প্রশ্ন হচ্ছে, তোমরা তোমাদের এ অর্জনকে নিয়ে কী করবে ভবিষ্যতে?
আজ পৃথিবীতে কী রয়েছে বদলে দেওয়ার? সেটি বদলে দেওয়ার জন্য তোমাদের পরিকল্পনাগুলো কেমন?
যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক উন্নত দেশে আইনের দৃষ্টিতে আমরা (নারী-পুরুষ সবাই) সম-অধিকার ভোগ করি। অথচ এ প্রতিশ্রুতি তো সবখানে সমান নয়। এই যে আজ আমরা নীল পোশাকে সমাবর্তনে বসে আছি, আমাদের মানতেই হবে পুরুষেরাই পৃথিবী শাসন করছে। ১৯০ জন রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে নারীর সংখ্যা মাত্র নয়। সারা পৃথিবীর সংসদগুলোয় নারীর সংখ্যা শতকরা মাত্র ১৩ জন। যুক্তরাষ্ট্রের করপোরেট জগতে শতকরা ১৫ জন নারী, যা বিগত নয় বছরে বদলাইনি। অধ্যাপকের মধ্যে পুরো যুক্তরাষ্ট্রে মাত্র শতকরা ২৪ জন নারী অধ্যাপক রয়েছেন।
আমি স্বীকার করি, আমাদের অতীত প্রজন্মের তুলনায় অনেক উন্নতি হয়েছে নারীদের জীবনে। আমার মায়ের সমাবর্তনের দিন তাঁর মনে হয়েছিল সেবিকা কিংবা শিক্ষকতা করার দুটি পথ খোলা আছে তাঁর। মা আমাকে আর আমার বোনকে বড় করেছেন এই বিশ্বাসকে ধারণ করে যে আমরা পৃথিবীর সবকিছু অর্জন করার সুযোগ পাব। কিন্তু আমার কষ্ট হয় ভাবলে যে আমাদের প্রজন্ম কী করছে নারীদের পথ খুলে দেওয়ার জন্য?
৩০ বছর আগে ১৯৮১ সালে যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে নারীদের মধ্যে ৫০ শতাংশ স্নাতক হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করে। ৩০ বছরে সেই স্নাতকরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু সিদ্ধান্ত নেওয়ার টেবিলে আমাদের স্থান কোথায়? পৃথিবীকে বদলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণে আমরা কি সমান সুযোগ পাই? তাই আজ থেকে এ দায়িত্ব পালনের ভার রইল তোমাদের। তোমরাই আরও সমান একটি বিশ্ব গড়ার প্রতিশ্রুতি নেবে। তোমরাই আমাদের ভরসা। আমি সত্যিকার অর্থে বিশ্বাস করি, যখন আমরা জেন্ডার বৈষ্যম্য দূর করতে পারব, সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারব, তখনই আমরা সরকারব্যবস্থা, প্রশাসন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে সমান সুযোগ অর্জন করতে পারব। আমাদের প্রয়োজন সর্বোচ্চ থেকে সর্বনিম্ন— প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর সমান অবস্থান। নারীদের উপদেশ কিংবা ভুলে যাওয়া নয়, পৃথিবীর গতিকে বদলে দিতে, আমাদের কথোপকথনের ধরন বদলে দিতে। প্রতিটি নারীর কথা শোনা এবং শোনানোর জন্য প্রয়োজন তোমাদের। তাই আমার আশা, এখানে উপস্থিত প্রত্যেক স্নাতককে নিয়ে, যা বদলে দেবে পৃথিবী।
তো, জীবনে তোমাদের লক্ষ্য অর্জনে কী উপদেশ দেব তোমাদের? প্রথমে আমি যা বলে তোমাদের উৎসাহিত করতে চাই তা হলো, চিন্তার জগৎ বিস্তৃত করো। সমীক্ষায় দেখা গেছে, নারীদের চেয়ে পুরুষেরা অনেক উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়। স্নাতক হওয়ার দিন থেকে তারা উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে কর্ম জীবনের প্রতিটি দিন অতিবাহিত করে। আমরা তো কখনোই সফলতা অর্জনের শূন্যতার কাছে পৌঁছাতে পারব না, যদি আমরা আমাদের আকাঙ্ক্ষার শূন্যতা পূরণ না করি। কিন্তু যদি আজ থেকে আমরা সব স্নাতক নারীর আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য এগিয়ে না যাই, তবে কেমন করে বড় কিছু অর্জনে আমরা সফল হব। নেতৃত্বপ্রদানের সুযোগ তাদের হাতেই আসে, যা নেতৃত্বপ্রদানের জন্য এগিয়ে যায়। আর তোমাদের সবার সামনে আজ নেতৃত্ব গ্রহণের দিন এসেছে।
সফলতার পরবর্তী ধাপ হলো নিজের ক্ষমতা এবং সম্ভাবনায় বিশ্বাস করা যে একদিন তুমি পারবেই। দেখা গেছে, পুরুষদের তুলনায় নারীরা তাঁদের কর্মক্ষমতায় কম আস্থা রাখেন। যদি তুমি একজন পুরুষকে তার সফলতার কারণ জিজ্ঞেস করো, সে সফলতার জন্য তার নিজেকেই তুলে ধরবে, কিন্তু নারীরা বলবে কঠোর পরিশ্রম, অন্যদের সহযোগিতাসহ অন্যান্য বিষয়কে। নারীরা বলবে, “আমি ভাগ্যবান, আমি পরিশ্রম করেছি, অনেকের সাহায্য পেয়েছি।” পুরুষেরা বলবে, “কী অদ্ভুত প্রশ্ন, আমি যোগ্য এবং আমি অসাধারণ।” তাই নারীদের শিখতে হবে পুরুষদের থেকে, যাতে তারা তাদের সফলতাকে নিজের করে ধারণ করতে পারে। আমার ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছিল।
যদি তুমি অনেক বড় কিছু স্বপ্ন দেখো, নিজের সফলতাকে নিজের মাঝে ধারণ করে নাও, যদি তুমি নেতৃত্ব দাও, তাহলে বাইরে অনেক কিছুর মূল্য চুকিয়ে ব্যক্তিগত জীবনেও কিছুটা বিসর্জন দিতে হয়। পুরুষদের অবশ্য নারীদের চেয়ে অনেক কম ত্যাগ করতে হয় পেশাদার ও ব্যক্তিগত জীবনে সফল হওয়ার জন্য। পুরুষদের দিনের যতটুকু সময় কাজ করতে হয়, নারীদের তার থেকে দ্বিগুণ কাজ করতে হয় এবং তাদের থেকে তিনগুণ বেশি পরিবারের খেয়াল রাখতে হয়। তাই নারীদের ক্ষেত্রে কর্মজীবনের একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়—তুমি কি জীবনসঙ্গী চাও না? চাইলে সে কে? যদি তুমি এমন কাউকে বেছে নাও যে তোমার ব্যক্তিগত জীবনের সব বোঝা এবং সুখ ভাগাভাগি করবে, তাহলে তুমি জীবনে অনেক এগিয়ে যেতে পারবে। পৃথিবীটা হয়তো তাহলে আরও অনেক সুন্দর হবে, যদি পুরুষেরা সংসারের অর্ধেক দায়িত্বের ভার নেয় আর নারীরা কর্মক্ষেত্রের অর্ধেক দায়িত্বের ভার নেয়।
আমার ছয় বছরের একটি ছেলে এবং তিন বছরের একটি মেয়ে আছে। তাদের ঘিরে আমার স্বপ্নের শেষ নেই। আমি চাই আমার ছেলে ও মেয়ে উভয়েই তাদের পরিবারে এবং বাইরে সমান দায়িত্ব পালন করবে। কাজ আর সংসারের ভারসাম্য করে কীভাবে তারা চলবে, সেটা বলা কঠিন। কারণ, জীবনে উত্থান-পতন আছেই। জীবনের নানা মোড়ই আমাদের সম্ভাবনা তৈরি করে এবং এগিয়ে নিয়ে যায়। সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত সবকিছু করে যাও, যাতে ওই দিন তোমরা সফলভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারো। তাহলে, জীবনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য কী বেছে নেবে— প্রতিযোগিতা না অন্যের সংজ্ঞায়িত সফলতাকে? চেষ্টা করে যাও শেষ পর্যন্ত যতক্ষণ না তুমি তোমার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারছ, যতক্ষণ তুমি এমন একটা কাজ পাচ্ছ, যা তোমার ও সবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে তোমার আবেগ এবং কর্মদক্ষতাকে মিলিয়ে দাও। সাফল্য আসবেই। আমি তোমাদের প্রতীক্ষায় আছি। আমি জানি, এটি অনেক বড় একটি চ্যালেঞ্জ। অনেক ভীতিপ্রদ। তাই বাসায় গিয়ে রাতে চিন্তা করো, আমি যদি ভয় না-ই পাই, তাহলে করব কীভাবে এ দায়িত্ব পালন।’ এরপর এগিয়ে যাও পৃথিবী জয়ের জন্য। অভিনন্দন সবাইকে।

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ০৭, ২০১২

0 comments:

Thanks for Comment

Copyright © 2013 MEDIA INFO