গরমকালের অসুখ বিসুখ: সুস্থ থাকার কিছু টিপস

বাংলাদেশে এখন গরমকাল। গরমকালে বেশ কিছ‍ু অসুখ বিসুখের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়।
গরমকালে শরীরে ঘামের পরিমাণ বেড়ে যায়। সাধারণত ঘামের মাধ্যমে দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত হয়। কিন্তু পারিপার্শ্বিক পরিবেশের কারণে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার তারতম্য ঘটলে এই নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় সমস্যার সৃষ্টি হয়।
গরমের সময় তাপমাত্রা ও আদ্রতা বেড়ে যায়। ফলে শরীরে রক্তসঞ্চালন ক্রিয়া, কিডনিসহ শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর ওপর এই তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা বৃদ্ধির প্রভাব পড়ে। এর ফলে শরীরে দেখা দেয় বিভিন্ন অসুখ বিসুখ।
গরমে ত্বকের সমস্যা দেখা দিতে পারে। অতিরিক্ত ঘাম শরীরে শুকিয়ে গেলে, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ ও ধুলাবালির মধ্যে বেশিক্ষণ থাকলে ত্বকে সমস্যা দেখা দিতে পারে। সাধারণত এ সময় ঘামাচি, সামার বয়েল (ছোট লাল দানার মতো গোটা, যেখান থেকে পুঁজ তৈরি হতে পারে), পানি শূন্যতা ইত্যাদি দেখা দেয়।
এসব মোকাবেলায় বেশি করে পানি পান করতে হবে। পানির সঙ্গে অন্যান্য পানীয়, যেমন ডাবের পানি, ফলের জুস খাওয়ার মাধ্যমেও উপকার পাওয়া যেতে পারে।
তবে প্যাকেটজাত জুস না খেয়ে তাজা ফলের রস খাওয়াই ভালো। এছাড়া প্রতিদিন গোসল করতে হবে, সম্ভব হলে সাবান দিয়ে, এতে ত্বকের ওপর জমে থাকা ময়লা ও রোগ জীবাণু দূর হবে। ঘামাচির জন্য শরীরে নন-মেডিকেটেড ট্যালকম পাউডার করা যেতে পারে। সামার বয়েলের ওপর বরফ ঘষলে উপকার পাওয়া যাবে। তবে পেকে গিয়ে পুঁজ হলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ক্রিম লাগাতে হবে বা ওষুধ খাওয়াতে হবে। এছাড়া রোদে বাইরে বের হওয়ার আগে সম্ভব হলে শরীরের অনাবৃত অংশে সানস্ক্রিন লোশন মাখিয়ে নেওয়া উচিৎ।
গরমে পানিবাহিত অসুখ-বিসুখেরও প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। গরমের কারণে পানির চাহিদা বাড়ে। চাহিদা মেটাতে মানুষ অস্বাস্থ্যকর বিভিন্ন উৎস থেকে পানি সংগ্রহ করে। তাছাড়া গ্রীষ্মকালে তৃষ্ণা নিবারণের জন্য মানুষ রাস্তার পাশে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে প্রস্তুত আখের রস, তরমুজের জুস, আইসক্রিম, শরবত ইত্যাদি কিনে খায়। এর কারণেও দেখা দেয় বিভিন্ন ধরণের অসুখ বিসুখ।
গরমকালে অসুখ বিসুখের মধ্যে ডায়রিয়া, টাইফয়েড জ্বর, হেপাটাইটিস বি, লিভারের ইনফেকশন বা জন্ডিস, পেটের প্রদাহ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এসব অসুখ থেকে নিরাপদ থাকতে হলে অনিরাপদ উৎস থেকে পানি সংগ্রহ ও পান থেকে বিরত থাকতে হবে।
রাস্তায় পানির তেষ্টা পেলে প্রয়োজনে ভালো প্রতিষ্ঠানের বোতলজাত পানি কিনে খেতে হবে, কিন্তু রাস্তার পাশে বিক্রি হওয়া শসা, পেঁপে, তরমুজ, আখের রস, শরবত ইত্যাদি খাওয়া যাবে না। যে পানিতে ফলগুলো ধোয়া হয়, তা সাধারণত স্বাস্থ্যসম্মত হয় না।
এছাড়া দোকানে চা খাওয়ার ক্ষেত্রেও সাবধানে থাকতে হয়। কারণ যে পানিতে চা তৈরি হয়, তা বিশুদ্ধ নাও হতে পারে। অনেকে মনে করেন যে পানি গরম করলেই রোগজীবাণু মরে যায়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, পানি ফুটতে শুরু করার পর অন্তত ৩০ মিনিট আগুনে না রাখলে বেশির ভাগ জীবাণু মরে না। শরীরে পানি ও খনিজ লবণের অভাব পূরণের জন্য প্রয়োজনে ওরস্যালাইন ও গ্লুকোজ খেতে হবে। পেটের প্রদাহ এড়াতে বাসি, তেলে ভাজা-পোড়া খাবার এবং হোটেলে খাওয়া বাদ দিতে হবে।
গরমের আরেক আপদ মশা। গরমকালে এডিস ও অ্যানোফিলিস মশা অসুখ ছড়ায়। এর ফলে হতে পারে ডেঙ্গু জ্বর ও ম্যালেরিয়ার মত রোগ। মশা প্রতিরোধ করতে হলে বাড়ির আশপাশের ডোবা-নালা, ড্রেন পরিষ্কার রাখতে হবে। মশারি, মশার কয়েল ও ইনসেক্ট স্প্রে ব্যবহার করতে হবে। জ্বর দেখা দেওয়ামাত্রই অ্যান্টিবায়োটিক না খেয়ে অন্তত তিন দিন দেখে তারপর ওষুধ খেতে হবে। জ্বর কম রাখতে কোনো অবস্থাতেই এ সময় প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোনো ওষুধ খাওয়া যাবেনা।
গরমে ভাইরাসের কারণেও অসুখের সৃষ্টি হয়। গরমে ভাইরাল ফিভার বা ভাইরাস জ্বর, হাম ইত্যাদি অসুখ দেখা দেয়। ভাইরাল ফিভারে সাধারণত শরীরের মাংশপেশিতে ব্যথা হয়, সর্দিও থাকে। এমন লক্ষণ দেখা দিলে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার দরকার নেই। কারণ অ্যান্টিবায়োটিক ভাইরাসের বিপক্ষে কোনো কাজ করতে পারে না।
ভাইরাল জ্বরে আক্রান্ত হলে পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে। যেকোনো জ্বরেই শরীরে পানির ঘাটতি দেখা দেয়। এছাড়া জ্বর কমাতে গা স্পঞ্জ কর‍া যেতে পারে। হামে আক্রান্তদের অন্তত এক সপ্তাহ পূর্ণ বিশ্রামে থাকা উচিত।
গরমে প্রচুর ঘামার ফলে শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে। এর ফলে শরীরে রক্তশূন্যতা, দুর্বলতা, মাংসপেশিতে ব্যথা, অবসন্নতা, পেট ব্যথা, মাথা ঘোরানো ইত্যাদি রোগ দেখা দিতে পারে। এজন্য বেশি তাপমাত্রায় বা রোদে দীর্ঘ সময় কাজ কর‍া যাবে না। পাশাপাশি অভ্যাস না থাকলে ভারী কাজ ও শারীরিক পরিশ্রম থেকেও দূরে থাকতে হবে। এছাড়া বেশি করে পানি এবং অন্যান্য তরল জাতীয় খাবার বেশি করে খেতে হবে।
গরমে দেখা দিতে পারে হিট স্ট্রোক। হঠাৎ করে শরীরের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ১০৩ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি হলে শরীর আকস্মিকভাবে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এ সময় ত্বক শুকিয়ে যায়, পালস বেড়ে যায়, তীব্র মাথাব্যথা হয়, বমি বমি ভাব হয়। অনেক সময় রোগী অজ্ঞানও হয়ে যায়। এ রোগে আক্রান্ত হলে রোগীকে ছায়াযুক্ত স্থানে বাতাস করতে হবে। মাথায় পানি ঢেলে বা শরীর ভেজা কাপড় দিয়ে মুছে দিতে হবে। তবে হিটস্ট্রোক আক্রান্ত রোগীকে তাৎক্ষণিকভাবে মুখে পানি বা অন্য কোনো খাবার দেওয়া যাবে না।
গরমকালে সাধারণত বড়দের থেকে ছোটরাই বেশি আক্রান্ত হয়। তাই গরমের সময় তাদের প্রতি বাড়তি নজর রাখতে হবে।
খেয়াল রাখতে হবে বাচ্চার চোখ ভেতরে ঢুকে গেছে কি না, বাচ্চা কম প্রস্রাব করছে কি না, বা পাতলা পায়খানা বেশি হচ্ছে কি না। এর যেকোনো একটি লক্ষণ দেখা গেলেই দ্রুত ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। এ সময় শিশুদের মূলত ডিহাইড্রেশন ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হতে দেখা দেয়।
শিশুদের এ রোগ থেকে সুস্থ রাখতে মায়ের দুধ পান করা বাচ্চাকে ঘন ঘন দুধ খাওয়াতে হবে। আলাদা করে বাইরের দুধ বা পানি দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। বাতাস আছে বা ফ্যান আছে এমন ঘরে শিশুদের রাখতে হবে। তবে সরাসরি গায়ে বেশি বাতাস লাগে, এমন জায়গায় রাখা যাবে না। এছাড়া বাচ্চাদের কড়া রোদে বের করা যাবে না। ডিহাইড্রেশন ও পানিশূন্যতায় আক্রান্ত হলে দ্রুত স্যালাইন ও তরল জাতীয় খাবার খেতে দেওয়ার পাশাপাশি দ্রুত ডাক্তার দেখাতে হবে।

সুত্রঃ বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

0 comments:

Thanks for Comment

Copyright © 2013 MEDIA INFO