বিপ্লব ঘটাবে থ্রিডি প্রিন্টার

ধরুন একটি পানির গ্লাস কিনবেন। সেজন্য তো বাজারে যেতে হবে। কিন্তু কেমন হবে, যদি বাড়িতে বসেই সুইচ চেপে মুহূর্তে প্লাস্টিকের একটি গ্লাস তৈরি করে নিতে পারেন? কিংবা কেমন হবে, যদি জুতা কিনতে আর দোকানে যাওয়া না লাগে? ইন্টারনেটে মডেল দেখে নির্দেশ দিলেই ঘরের প্রিন্টার থেকে হুবহু সেই জুতাটি বেরিয়ে আসে?

কল্পনা বা সায়েন্স ফিকশন নয়। অহরহই এভাবে প্রিন্ট হচ্ছে ঘরের আসবাব থেকে শুরু করে বড় বড় মেশিন। আর এ বিপ্লব ঘটিয়েছে যে প্রযুক্তি, তার নাম থ্রিডি প্রিন্টার। যার ক্ষমতা আমাদের শরীরের ক্ষুদ্রতম কোষ থেকে আকাশছোঁয়া ভবন পর্যন্ত- এককথায় অসীম।

সাধারণ কম্পিউটার প্রিন্টিংয়ের সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত, যার কেবল দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ আছে। এর সঙ্গে উচ্চতা যোগ করলেই তা হয়ে যায় ত্রিমাত্রিক বস্তু। আমাদের চারপাশের জগত এই অগণিত ত্রিমাত্রিক বস্তু দিয়েই তৈরি। সুতরাং, সাধারণ প্রিন্টারে যেমন নির্দেশ দিলেই দ্বিমাত্রিক যেকোনো বস্তু প্রিন্ট হয়ে যায়, তেমনি ত্রিমাত্রিক কিংবা থ্রি-ডাইমেনশনাল (থ্রিডি) প্রিন্টারে নির্দেশ দিলে আমাদের বাস্তব জগতের যেকোনো বস্তুর হুবহু আদল প্রিন্ট হয়ে যাওয়ার কথা। যার দৈর্ঘ্য আছে, প্রস্থ, আছে, উচ্চতাও আছে।

চাক হালের হাত ধরে ১৯৮৪ সালে বিশ্বের প্রথম থ্রিডি প্রিন্টার বাজারে আসে। বাস্তব রূপ নেয় একসময়ের কল্পনা। তবে সেসময় এর ক্ষমতা খুবই সীমিত ছিল। চলতি শতাব্দীর শুরুতে অন্যান্য প্রযুক্তির মতোই হঠাৎ এ প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার হয় এবং দাম কমার ফলে দ্রুত সাধারণ গ্রাহকের হাতের নাগালে আসে। যে প্রযুক্তি একসময় ব্যবহৃত হতো কেবল বড় বড় কারখানায় গাড়ি কিংবা মেশিনের মডেল তৈরিতে, তা দিয়ে কৌতূহলী কিশোর-কিশোরীরা ঘরে বসে জুতা, খেলনা, পুতুল, গয়না ইত্যাদি তৈরি শুরু করে।

একটি প্রশ্ন মনে জাগতে পারে। সাধারণ প্রিন্টার তো কালি ব্যবহার করে প্রিন্ট করে, থ্রিডি প্রিন্টার কালির জায়গায় কি ব্যবহার করে?

এর উত্তরেই লুকিয়ে আছে নতুন এ প্রযুক্তির ব্যাপকতা। সাধারণভাবে থ্রিডি প্রিন্টারের জন্য বিশেষ ধরনের প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়। তবে বর্তমানে সিরামিক, বালু, চিনি, চকলেট এবং বিভিন্ন ধাতুও ব্যবহার করা হচ্ছে, যার ফলে এ দিয়ে যেকোনো আকৃতির, যেকোনো ধর্মের, যেকোনো ডিজাইনের প্রতিকৃতি তৈরি করা সম্ভব। কাঙ্খিত বস্তু একেবারে রেডিমেড পাওয়ায় এতে আলাদা করে কাটাছেঁড়া, ড্রিল ইত্যাদির দরকার পড়ে না।

থ্রিডি প্রিন্টারের কার্যপদ্ধতিও বেশ জটিল। এটি ত্রিমাত্রিক অ্যাডিটিভ ম্যানুফ্যাকচারিং নামে একটি পদ্ধতি ব্যবহার করে। এতে ব্যবহারকারী কম্পিউটারে সফটওয়্যারের মাধ্যমে কোনো বস্তুর ত্রিমাত্রিক মডেল তৈরি করেন। এরপর একে কয়েকটি স্তরে বিন্যস্ত করেন। প্রতিটি স্তর সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সফটওয়্যারে তথ্য প্রবেশ করান। প্রিন্টার এ তথ্য পুনরায় বিশ্লেষণ ব্যবহারকারীর নির্দেশিত পথে একের পর এক স্তর তৈরি করে। এভাবে সবগুলো স্তর সম্পন্ন হলে তৈরি হয় কাঙ্খিত বস্তু। ব্যাপারটা অনেকটা ইঁটের গাঁথুনি দিয়ে বাড়ি বানানোর মতোই।

থ্রিডি প্রিন্টার আবিষ্কারের ফলে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ইতোমধ্যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসা শুরু হয়েছে। অনেকে মনে করছেন, এ পরিবর্তন অনেকটা মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের মতোই বৈপ্লবিক। মধ্যযুগে মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের মাধ্যমে যেমন সাধারণ প্রিন্টিংয়ের শুরু হয়েছিল, তেমনি এবার শুরু হবে ত্রিমাত্রিক প্রিন্টিংয়ের যুগ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, “আমরা সবকিছু যেভাবে তৈরি করি, থ্রিডি প্রিন্টার সে প্রক্রিয়ায় বিপ্লব ঘটানোর ক্ষমতা নিয়ে এসেছে।”

ওবামার এ ধারণা যে মিথ্যা নয়, তার প্রমাণ ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি। তারা মহাশূন্যে চাঁদের কক্ষপথে যে স্পেস স্টেশন স্থাপন করতে যাচ্ছে, সেটি তৈরি হবে থ্রিডি প্রিন্টারের মাধ্যমে তৈরি চাঁদের বালুর ইট দিয়ে। আমস্টারডামের স্থপতিরা এতো বড় একটি থ্রিডি প্রিন্টার তৈরি করেছেন যা একটি কার্গো কন্টেইনার তৈরি করতে সক্ষম। শুধু তাই নয়, একই প্রক্রিয়ায় একটি আধুনিক ফার্নিশড অ্যাপার্টমেন্টও নির্মাণ করা সম্ভব!

থ্রিডি প্রযুক্তি এ নতুন সম্ভাবনাকে নতুন শিল্প বিপ্লব হিসেবে দেখছেন থ্রিডি প্রিন্টারের পথিকৃত সংগঠন ‘ফ্রিডম অব ক্রিয়েশন’ এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা জেন কিথানেন।

অবশ্য ইতোমধ্যেই থ্রিডি প্রিন্টার নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। বন্দুক তৈরির থ্রিডি নকশা ইন্টারনেটে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, যা দেখে থ্রিডি প্রিন্টার দিয়ে ঘরে বসেই বন্দুক তৈরি করেছেন অনেকে। এ বন্দুক আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ হলেও বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এভাবে অবাধে বন্দুক তৈরি হলে একপর্যায়ে সেটি মারণাস্ত্রের ক্ষমতাও লাভ করতে পারে।

এছাড়া থ্রিডি প্রিন্টার কপিরাইট বা মেধাস্বত্ত্ব নীতির উপরও হুমকিস্বরূপ। ঘরে বসেই যেকোনো বস্তুর হুবহু কপি তৈরি করা হলে মেধাস্বত্ত্ব বলে আর কিছু থাকবে না- এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

প্রিন্টার ভেদে দামের তারতম্য হয়ে থাকে। বর্তমানে বাজারে ৪শ ডলার থেকে ৫ লাখ ডলার পর্যন্ত দামের থ্রিডি প্রিন্টার রয়েছে। বাণিজ্যিকভাবে ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল ডিজাইন, অ্যারোস্পেস, মিলিটারি, ইঞ্জিনিয়ারিং, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, ডেন্টাল ও মেডিকেল ক্ষেত্রে, বায়োটেক, ফ্যাশন, ফুটওয়্যার, জুয়েলারি, শিক্ষা, ভুগোল, খাদ্যসহ সব ক্ষেত্রেই। আর বিভিন্ন কোম্পানি বাসায় ব্যবহারের জন্য সাধারণ থ্রিডি প্রিন্টার তৈরি করছে, যা ব্যবহার করে দৈনন্দিন ছোটখাটো জিনিস তৈরিতে সক্ষম।

বর্তমানে থ্রিডি প্রিন্টারের বাজার ১৭০ কোটি ডলারের। ২০১৫ সালের মধ্যে এটি ৩৭০ কোটি ডলার এবং ২০২৫ সালের ৮৪০ কোটি ডলার মধ্যে ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এসবের বাইরেও থ্রিডি প্রিন্টারের আরেকটি চমকপ্রদ দিক অচিরেই প্রসারিত হতে পারে। যে থ্রিডি প্রিন্টারে আমরা এখন প্লাস্টিক ব্যবহার করছি, কেমন হবে সেখানে শরীরের জীবিত কোষ বা টিস্যু ব্যবহার করলে? হ্যাঁ, এভাবে তৈরি করা সম্ভব শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। যা বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন গবেষণাগারে তৈরি করছেন। ত্বক, হাড়ের কার্টিলেজ থেকে শুরু করে হৃৎপিণ্ড, ফুসফুসের মতো জটিল অঙ্গ এভাবে তৈরি করা সম্ভব হয়েছে।

আর এতোকিছুই যখন প্রিন্ট করা যাচ্ছে, সুতরাং নিশ্চয়ই মাছ-মাংস সহ যেকোনো ফলমূল, খাদ্যই প্রিন্ট করা যাবে?

সে অপেক্ষার পালা যে বহুদূরে, তাও নয়। বিজ্ঞানীদের মতে, ২০৫০ সাল নাগাদই আমরা দেখতে পাবো থ্রিডি প্রিন্ট প্রযুক্তি দিয়ে আমূল বদলে যাওয়া এক বিশ্বকে।

=> বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম’

0 comments:

Thanks for Comment

Copyright © 2013 MEDIA INFO