ইসলামী আন্দোলনের প্রাক্কালে দুনিয়ার অবস্থা -৩য় খন্ড
রসূলুল্লাহর বিপ্লবী জীবন
মূল:আবু সলীম মুহাম্মদ আবদুল হাই
অনুবাদ: মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান
ইসলামী আন্দোলনের প্রাক্কালে দুনিয়ার অবস্থা :-
ইসলাম মানুষের কাছে যে দাওয়াত পেশ করেছে, তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বুনিয়াদ হচ্ছে তাওহীদ। কিন্তু এই তাওহীদের আলো থেকেই তখনকার আরব উপদ্বীপ তথা সমগ্র দুনিয়া ছিল বঞ্চিত।তৎকালীন মানুষের মনে তাওহীদ সম্পর্কে সঠিক কোন ধারণাই বর্তমান ছিল না।এ কথা সত্যি যে হযরত মুহাম্মদ (স) এর আগেও খোদার অসংখ্য নবী দুনিয়ায় এসেছেন এবং প্রতিটি মানব সমাজের কাছেই তারা তাওহীদের পয়গাম পেশ করেছেন।কিন্তু মানুষের দুর্ভাগ্য এই যে, কালক্রমে এই মহান শিক্ষা বিস্মৃত হয়ে সে নিজেরই ইচ্ছা-প্রবৃত্তির দাসত্বে লিপ্ত হয়ে পড়ে এবং তার ফলে চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-উপগ্রহ,দেব-দেবী, নদী-সমুদ্র, পাহপড়-পর্বত, জ্বিন-ফেরেশতা, মানুষ-পশু ইত্যাকার অনেক বস্তুকে নিজের উপাস্য বা মাবুদের মধ্যে শামিল করে নেয়।এভাবে মানুষ এ খোদার নিশ্চিত বন্দেগীর পরিবর্তে অসংখ্য মাবুদের বন্দেগীর আবর্তে জড়িয়ে পড়ে।
রাজনৈতিক দিক থেকে তখন পারস্য ও রোম এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি বর্তমান ছিলো । পারস্যের ধর্মমত ছিলো অগ্নিপূজা (মাজুসিয়াত) । এর প্রতিপত্তি ছিলো ইরাক থেকে ভারতের সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত। আর রোমের ধর্ম ছিলো খ্রিষ্টবাদ(ঈসাইয়াত)।এটি গোটা ইউরোপ ,এশিয়া ও আফ্রিকাকে পরিবেষ্টন করে ছিলো। এ দুটি বৃহৎ শক্তি ছাড়া ধর্মীয় দিক থেকে ইহুদী ও হিন্দু ধর্মের কিছুটা গুরুত্ব ছিলো। এরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ এলাকায় সভ্যতার দাবি করত।
অগ্নিপূজা ছাড়া পারস্যে (ইরানে) নক্ষত্রপূজারও ব্যাপক প্রচলন ছিলো। সেই সঙ্গে রাজা-বাদশা ও আমির-ওমরাগণ ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রজাদের খোদা ও দেবতার আসনে অধিষ্ঠিত ছিলো। তাদেরকে যথারীতি সিজদা করা হত এবং তাদের খোদায়ীর প্রশস্তিমূলক সংগীত পরিবেশন করা হত।মোট কথা,সারা দুনিয়া থেকেই তাওহীদের ধারণা বিদায় নিয়েছিলো।
রোম সাম্রজ্য
গ্রীসের পতনের পর রোম সাম্রাজ্যকেই তখন দুনিয়ার সবচেয়ে সেরা শক্তি বলে বিবেচনা করা হত। কিন্তু ঈসায়ী ষষ্ঠ শতকের শেষভাগে এই বৃহৎ সাম্রাজ্যই অধঃপতনের শেষ প্রান্তে এসে উপনীত হয়। রাষ্ট-সরকারের অব্যাবস্থা,শত্রুর ভয়,অভ্যন্তরীন অশান্তি ,নৈতিকতার বিলুপ্তি, বিলাসিতার আতিশয্য-এক কথায় তখন এমন কোন দুষ্কৃতি ছিলো না ,যা লোকেদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করেনি। ধর্মীয় দিক থেকে তো কিছু লোক নক্ষত্র ও দেবতার কল্পিত মূতির পূজা-উপাসনায় লিপ্ত ছিলোই;কিন্তু যারা ঈসার ধর্মের অনুসারী বলে নিজেদের দাবি করত, তারাও তাওহীদের ভাবধারা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্যুত হয়ে পড়েছিলো। তারা হযরত ঈসা(আঃ) ও মরিয়মের খোদায়ী মর্যাদায় বিশ্বাসী ছিলো। পরন্ত তারা অসংখ্য ধর্মীয় ফির্কায় বিভক্ত হয়ে পড়েছিলো এবং পরস্পর লড়াই-ঝগড়ায় লিপ্ত থাকতো। তাদের মধ্যে কবর পূজার ব্যাপক প্রচলন ছিলো। পাদ্রীদের তারা সিজদা করত। পোপ ও বিভিন্ন পর্যায়ের ধর্মীয় পদাধিকারীগণ বাদশাহী,এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে খোদায়ী ক্ষমতা পর্যন্ত করায়ত্ত করে রেখেছিলো। হারাম ও হালালের মাপকাঠী তাদের হাতেই নিবদ্ধ ছিলো। তাদের কথাকে ‘খোদায়ী আইন’ বলে গণ্য করা হত। পাশাপাশি সংসারত্যাগ বা সন্ন্যাস ব্রতকে ধার্মিকতার উচ্চাদর্শ বলে মনে করা হতো এবং সকল প্রকার আরাম আয়েশ থেকে দেহকে মুক্ত রাখাই শ্রেষ্ঠ ইবাদত বলে বিবেচিত হতো।
ভারতবর্ষ
ধর্মীয় দিক থেকে ভারতে তখন‘পৌরাণিক যুগ’ বিদ্যমান ছিলো। ভারতের ধর্মীয় ইতিহাসে এই যুগটিকে সবচেয়ে অন্ধকার যুগ বলে গণ্য করা হয়। কারণ এ যুগে ব্রাহ্মণ্যবাদ পুনরায় প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিলো এবং বৌদ্ধদেরকে প্রায় নির্মূল করে দেয়া হয়েছিলো। এ যুগে শির্কের চর্চা মাত্রাতিরিক্ত রকমে বেড়ে গিয়েছিলো। দেবতাদের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে ৩৩ কোটি পর্যন্ত পৌঁছেছিলো। কথিত আছে যে,বৈদিক যুগে কোন মূর্তি পূজার প্রচলন ছিলনা। কিন্তু এ যুগে মূর্তিপূজার ব্যাপক প্রচলন ঘটেছিলো। মন্দিরের পুরোহিতগণ অনৈতিকতার এক জীবন্ত প্রতীক। সরল প্রাণ লোকেদের শোষাণ ও লুন্ঠন করাই ছিল তাদের প্রধান কাজ। সে যুগে বর্ণবাদ বা জাতিভেদ প্রথার বৈষম্য চরমে পৌছেছিল। এর ফলে সামাজিক শৃংখলা ও ব্যাবস্থাপনা ধ্বংস হয়েছিল। সমাজপতিদের খেয়াল-খুশি মতো আইন কানুন তৈরি করে নেয়া হয়েছিল বিচার ইনসাফকে সম্পূর্ণরুপে হত্যা করা হয়েছিল। বংশ-গোত্রের দৃষ্টিতে লোকেদের মর্যাদা নিরুপন করা হতো। সাধারণ্যে মদপানের ব্যাপক প্রচলন ঘটেছিলো। তবে খোদা প্রাপ্তির জন্য বন-জঙ্গল ও পাহাড়-পর্বতে জীবন কাটানো কে অপরিহার্য মনে করা হতো। কুসংস্কার ও ধ্বংসাত্নক চিন্তাধারা চরমে পৌছেছিলো। ভূত প্রেত , শুভাশুভ গণন এ ভবিষ্যৎ কথনে বিশ্বাস গোটা মানব জীবনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো। যে কোন অদ্ভুত জিনিসকেই ‘খোদা’ বলে গণ্য করা হতো। যে কোন অস্বাভাবিক বস্তুর সামনে মাথা নত করাই ধর্মীয় কাজ বলে বিবেচিত হতো। দেব-দেবী ও মূর্তির সংখ্যা গণনা তো দূরের কথা , তা আন্দাজ অনুমানেরও সীমা অতিক্রম করেছিলো। পূজারিণী ও দেবদেবীদের নৈতিক চরিত্র অত্যন্ত লজ্জাকর অবস্থায় উপনীত হয়েছিলো। ধর্মের নামে সকল প্রকার দুষ্কর্ম ও অনৈতিকতাকে সর্মথন দেয়া হতো। এক এক জন নারী একাধিক পুরুষকে স্বামীরুপে গ্রহণ করতো। বিধবা নারীকে আইনের বলে সকল প্রকার সুখ সম্ভোগ থেকে জীবনভর বঞ্চিত করে রাখা হতো। এই ধরনের জুলুম মূলক সমাজরীতির ফলে জীবন- নারী তার মৃত স্বামীর জ্বলন- চিতায় ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুবরণ করতে পর্যন্ত স্বীকৃত হতো। যুদ্ধে হেরে যাবার ভয়ে বাপ,ভাই ও স্বামী তাদের কন্যা , ভগ্নি ও স্ত্রীকে স্বহস্থে হত্যা করে ফেলতো এবং এতে তারা অত্যন্ত গর্ববোধ করতো। নগ্ন নারী ও নগ্ন পুরুষের পূজা করাকে পূণ্যের কাজ বলে গণ্য করতো। পূজা পার্বণ উপলক্ষে মদ্যপান করে তারা নেশায় চুর হয়ে যেত। মোদ্দাকথা, ধর্মাচরণ, নৈতিকতা ও সামাজিকতার দিক দিয়ে খোদার এই ভূখন্ডটি শয়তানের এক নিকৃষ্ট লীলাভূমিতে পরিণত হয়েছিলো।
ইহুদী
আল্লাহর দ্বীনের অনুসারী হিসেবে কোনো সংস্কার-সংশোধন যদি প্রত্যাশা করা যেতো, তাহলে ইহুদীদের কাছ থেকেই করা যেতে পারতো। কিন্তু তাদের অবস্থাও তখন অধঃপতনের চরম সীমায় পৌছে গিয়েছিলো। তারা তাদের দীর্ঘ ইতিহাসে এমন সব গুরুতর অপরাধ করেছে যে, তাদের পক্ষে কোনো সংস্কার মূলক কাজ করাই সম্ভব ছিলো না। তাদের মানসিক অবস্থা অত্যন- শোচনীয় আকার ধারণ করেছিলো। ফলে তাদের ভেতর কোনো নবীর আগমন ঘটলে তাঁর কথা শুনতে পর্যন্ত তারা প্রস্তুত ছিলো না। এজন্যে কতো নবীকে যে তারা হত্যা করেছে তার ইয়ত্তা নেই। তারা এরুপ ভ্রান্ত ধারণায় নিমজ্জিত ছিলো যে, খোদার সাথে তাদের একটি বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে ; সুতরাং কোনো অপরাধের জন্যেই তিনি তাদের শাস্তি দেবেন না। তারা এ-ও ধারণা করতো যে, বেহেস্তের সকল সুখ-সম্ভোগ শুধু তাদের জন্যেই নির্দ্দিষ্ট করে রাখা হয়েছে।নবুয়্যাত ও রিসালাতকে তারা নিজেদের মীরাসী সম্পত্তি বলে মনে করতো। তাদের আলেম সমাজ দুনিয়া-পুজা ও যুগ-বিভ্রান্তিতে চরমভাবে লিপ্ত হয়ে পড়েছিলো। বিত্তশালী ও শাসক সম্প্রদায়ের মনোতুষ্টির জন্যে সবসময় তারা ধর্মীয়বিধি-বিধানে হ্রাস-বৃদ্ধি করতে থাকতো। খোদায়ী বিধান সমূহের মধ্যে যেগুলো অপেক্ষাকৃত সহজতর এবং তাদের মর্জি মাফিক,সে গুলোই তারা অনুসরণ করতো;পক্ষান্তরে যেগুলো কঠিন ও অপছন্দনীয় ,সেগুলো অবলীলাক্রমে বর্জন করতো।
পরস্পর যুদ্ধ-বিগ্রহ ও খুন খারাবী করা তৎকালীন ইহুদীদের একটা সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়েছিলো। ধন-মালের লালসা তাদেরকে সীমাহীনভাবে অন্ধ করে তুলেছিলো এবং এদিক থেকে কিছুমাত্র ক্ষতি হতে পারে, এমন কোন কাজ করতেই তারা প্রস্তুত ছিলো না। এর ফলে তাদের নৈতিক চরিত্র অত্যন্ত দূর্বল হয়ে পড়েছিল। তাদের ভেতরে মুশরিকদের মত মূর্তিপূজাও প্রভাব বিস্তার করেছিল। যাদু-টোনা,তাবিজ-তুমার, আমল-তদবীর ইত্যাদি অসংখ্য প্রকার কুপ্রথা তাদের মধ্যে ঢুকে পড়েছিলো এবং তওহীদের সঠিক ধারণাকে তা নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিলো। এমন কি,যখন আল্লাহর শেষ নবী তওহীদের সঠিক দাওয়াত পেশ করেন। তখন এই ইহুদীরাই মুসলমানদের চেয়ে আরব মুশরিকদেরকে উত্তম বলে ঘোষণা করেন।
আরব দেশের অবস্থা
দুনিয়ার ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অবস্থা পর্যালোচনার পর এবার খোদ আরব দেশের প্রতি আমরা দৃষ্টিপাত করবো। কারণ, এই গুরুত্বপূর্ণ ভূ-খণ্ডেই আল্লাহর সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী তার আন্দোলনের সূত্রপাত করেন এবং এখানকার পরিস্থিতিই তাকে সর্বপ্রথম মুকাবেলা করতে হয়।
আরবের একটি বিরাট অংশ- কোরা উপত্যকা, খায়বার ও ফিদাকে তখন বেশির ভাগ বাসিন্দাই ছিল ইহুদী। খোদ মদীনায় পর্যন্ত ইহুদীদের আদিপত্য কায়েম ছিল। বাকী সারা দেশে পৌত্তলিক রীতি-রেওয়াজ প্রচলিত ছিল। লোকেরা মূতি,পাথর ,নক্ষত্র,ফেরেশতা, জ্বিন প্রভৃতির পূজা-উপাসনা করতো ।অবশ্য এক আল্লাহর ধারণা তখনও কিছুটা বর্তমান ছিল। তবে তা শুধু এই পর্যন্ত যে, লোকেরা তাকে খোদাদের খোদা বা ‘সবচাইতে বড় খোদা’ বলে মনে করত। আর এই আকিদাও এতটা দুর্বল ছিল যে কার্যত তারা নিজেদের মনগড়া ছোটখাটো খোদাগুলোর পূজা উপাসনায়ই লিপ্ত থাকতো। তারা বিশ্বাস করতো যে, মানুষের দৈনন্দিন জীবনে এই সব ছোট খাটো খোদার প্রভাবই কার্যকর হয়ে থাকে। তাই বাস্তব ক্ষেত্রে তারা এগুলেরই পূজা উপাসনা করতো। এদের নামেই মানত মানতো ও কুরবানী করতো এবং এদের কাছেই নিজ নিজ বাসনা পূরণের আবেদন জানাতো। তারা এও ধারণা করতো এসব ছোট খাটো খোদাকে সন্তষ্ট করলেই আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তষ্ট হবেন।
এ ভ্রান্ত লোকেরা ফেরেস্থতাদেরকে খোদার পুত্র কন্যা বলে আখ্যা দিত। জ্বীনদের কে খোদার ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং খোদায়ীর অন্যতম শরিকদার বলে ধারণা করতো এবং এই কারণে তারা তাদের পূজা-উপাসনা করতো, তাদের কাছে সাহায্য কামনা করতো। যে সব শক্তিকে এরা খোদায়ীর শরিকদার বলে মনে করতো, তাদের মূর্তি বানিয়ে যথারীতি পূজা-উপাসনাও করতো। মূর্তি পূজার এতোটা ব্যাপক প্রচলন ঘটেছিল যে, কোথাও কোন সুন্দর পাথর খন্ড দৃষ্টি গোচর হলেই তারা তার পূজা-উপাসনা শূরু করে দিত। এমনকি, একান্তই কিছু না পাওয়া গেলে মাটির একটা স্তুপ বানিয়ে তার উপর কিছুটা ছাগ-দুগ্ধ ছিটিয়ে দিত এবং তার চারদিক প্রদক্ষিণ করতো।
মোট কথা, পূজা-উপাসনার জন্য আরবরা অসংখ্য প্রকার মূর্তি নির্মান করে নিয়েছিল। এসকল মূর্তির পাশাপাশি তারা গ্রহ নক্ষত্রেরও পূজা করতো। বিভিন্ন গোত্রের লোকেরা বিভিন্ন নক্ষত্রের পূজা করতো। এর ভিতর সূর্য ও চন্দ্রের পূজাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তারা জ্বিন-পরী এবং ভূত-প্রেতেরও পূজা করতো। এদের সম্পর্কে নানা প্রকার অদ্ভূত কথা তাদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। এছাড়া মুশরিক জাতি গুলোর মধ্যে আর যে সব কুসংস্কারের প্রচলন দেখা যায়,সেসব ও এদের মধ্যে বর্তমান ছিল।
এহেন ধর্মীয় বিকৃতির সাথে সাথে পারস্পারিক লড়াই-ঝগড়া আরবদের মধ্যে একটা সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়েছিল। মামুলি বিষয়াদি নিয়ে তাদের মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ শুরু হয়ে যেতো এবং বংশ পরম্পরায় তার জের চলতে থাকতো। জুয়াখেলা ও মদ্যপানে তারা এতটা অভ্যস্থ হয়ে পড়েছিল যে, তখনকার দিনে আর কোন জাতিই সম্ভবত তাদের সমকক্ষ ছিল না।মদের প্রশস্তি এবং তার সাথে সংশ্লিষ্ট দুষ্কর্মগুলো প্রসংসায় তাদের কাব্য-সাহিত্য পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। এছাড়া সুদী কারবার,লুটপাট,চৌর্যবৃত্তি,নৃশংসতা রক্তপাত, ব্যভিচার, এবং এ জাতীয় অন্যান্য দুষ্কর্ম তাদেরকে প্রায় মানবরুপি পশুতে পরিণত করেছিল।আপন কন্যা সন্তানকে তারা অপয়া ভেবে জীবন্ত দাফন করতো। নির্লজ্জ আচরণে তারা এতদূর পর্যন্ত পৌঁছেছিল যে, পুরুষ ও নারীর একত্রে নগ্নাবস্থায় কাবা শরীফ তওয়াফ করাকে তারা ধর্মীয় কাজ বলে বিবেচনা করতো। মোটকথা,ধর্মীয়,নৈতিক,সামাজিক,ও রাজনৈতিক জীবনে তখনকার আরব ভূমি অধঃপতনের চরম সীমায় উপনীত হয়েছিল।
ইসলামী আন্দোলনের জন্যে আরব দেশের বিশেষত্ব
আরব উপদ্বীপ তথা সমগ্র বিশ্বব্যাপী এই ঘোর অমানিশার অবসান ঘটিযে আল্লাহর পথভ্রষ্ট বান্দাদেরকে তারই মনোনীত পথে চালিত করার জন্যে একটি শুভ প্রভাতের যে একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল, এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এই শুভ প্রভাতটির সূচনার জন্যে আল্লাহ তা’আলা সারা দুনিয়ার মধ্যে আরব দেশকে কেন মনোনীত করলেন, প্রসঙ্গত এই কথাটিও আমাদের ভেবে দেখা দরকার।
আল্লাহ তা’আলা হযরত মুহাম্মদ(স)- কে সারা দুনিয়ার জন্যে হেদায়াত ও দিক-নির্দেশনা সর্বশেষ পয়গামসহ পাঠানোর জন্যে মনোনীত করেছিলেন। সুতরাং তার দাওয়াত সমগ্র দুনিয়ায়ই প্রচারিত হবার প্রয়োজন ছিল। স্পষ্টতই বোঝা যায় যে, এই বিরাট কাজের জন্যে কোন এক ব্যক্তির জীবন-কালই যথেষ্ট হতে পারে না।এর জন্যে প্রয়োজন ছিল :আল্লাহর নবী তার নিজের জীবদ্দশায়ই সৎ ও পুণ্যবান লোকদের এমন একটি দল তৈরি করে যাবেন, যারা তার তিরোধানের পরও তার মিশনকে অব্যাহত রাখবেন। আর এই গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্যে যে ধরনের বিশেষত্ব ও গুণাবরীর প্রয়োজন ছিল, তা একমাত্র আরব অধিবাসীদের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি উন্নত মানের এবং বিপুল পরিমানে পাওয়া যেত । উপরন্ত আরবের ভৌগোলিক অবস্থানকে দুনিয়ার জনবসতিপূর্ণ এলাকার প্রায় কেন্দ্রস্থল বলা চলে। এসব কারণে এখান থেকেই নবীজীর দাওয়াত চারদিকে প্রচার করা সবদিক থেকেই সুবিধাজনক ছিল।
এছাড়া আরবী ভাষারও একটি অতুলনীয় বিশেষত্ব ছিল। কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে এই ভাষায় যতটা সহজে ও হৃদয়গ্রাহী করে পেশ করা যেতো, দুনিয়ার অন্য কোন ভাষায় তা সম্ভবপর ছিল না। সর্বোপরি, আরবদের একটা বড়ো সৌভাগ্য ছিল যে, তারা কোনো বিদেশি শক্তির শাসনাধীন ছিল না। গোলামীর অভিশাপে মানুষের চিন্তা ও মানসিকতার যে নিদারুণ অধঃগতি সূচিত এবং উন্নত মানবীয় গুণাবলীরও অপমৃত্যু ঘটে,আরবরা সে সব দোষ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিল। তাদের চারদিকে পারস্য ও রোমের ন্যায় বিরাট দুটি শক্তির রাজত্ব কায়েম ছিল; কিন্তু তাদের কেউই আরবদের কে গোলামীর শৃঙ্খলে আবদ্ধ করতে পারেনি ।তারা ছিল দুর্ধর্ষ প্রকৃতির বীর জাতি; বিপদ-আপদকে তারা কোনোদিন পরোয়া করতো না। তারা ছিল স্বভাবগত বীর্যবান;যুদ্ধ-বিগ্রহকে তারা মনে করতোএকটা খেল-তামাসা মাত্র । তারা ছিল অটল সংকল্প আর স্বচ্ছ দিলের অধিকারী। যে কথা তাদের মনে জাগতো,তা-ই তারা মুখে প্রকাশ করতো। গোলাম ও নির্বোধ জাতিসমূহের কাপুরুষতা ও কপট মনোবৃত্তির অভিশাপ থেকে তারা ছিল সম্পূর্ণ মুক্ত। তাদের কাণ্ডজ্ঞান,বিবেক-বুদ্ধিও মেধা-প্রতিভা ছিল উন্নত মানের। সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ কথাও তারা অতি সহজে উপলব্ধি করতে পারতো। তাদের স্মরণ শক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর; এক্ষেত্রে সমকালীন দুনিয়ার কোনো জাতিই তাদের সমকক্ষ ছিল না।তারা ছিল উদারপ্রাণ, স্বাবলম্বী ও আত্ম-মর্যাদা সম্পূর্ণ জাতি। করো কাছে মাথা নত করতে তারা আদৌ অভ্যস্ত ছিল না। সর্বোপরি, মরুভূমির কঠোর জীবন-যাত্রায় তারা হয়ে ওঠেছিল নিরেট বাস্তববাদী মানুষ। কোন বিশেষ পয়গাম কবুল করার পর বসে বসে তার প্রশস্তি কীর্তন করা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না;বরং সে পয়গামকে নিয়ে তারা মাথা তুলে দাঁড়াতো এবং তার পিছনে তাদের সমগ্র শক্তি-সামর্থ্য নিয়োজিত করতো।
আরবদের সংশোধনের পথে বাধা
আরব দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, তার শক্তিশালী ভাষা এবং তার বাসিন্দাদের এসব বৈশিষ্ট্যের কারণেই আল্লাহ তা’আলা তাঁর সর্বশেষ নবীকে এই জাতির মধ্যে প্রেরণ করার সিদ্ধান্ত করেন, সন্দেহ নেই।কিন্তু এই অদ্ভূত কওম কে সংশোধন করতে গিয়ে খোদ হযরত মুহাম্ম্দ (স)-কে যে বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়, তার গুরুত্বও কোনো দিক দিয়ে কম ছিল না। আগেই বলেছি, কোনো কাজের সঠিক মূল্যায়ন করতে হলে সে কাজটির চারদিকের অবস্থা ও পরিবেশের কথা বিচার করা প্রয়োজন ।এই দৃষ্টিতে বিচার করলে আরব ভূমির সেই ঘনঘোর অন্ধকার যুগে এ ইসলামী আন্দোলনের সূচনা ও তার সাফল্যকে ইতিহাসের এক নজিরবিহীন কীর্তি বলে অভিহিত করতে হয়। আর একারণেই আরবদের ন্যায় একটি অদ্ভূত জাতিকে দুনিয়ার নেতৃত্বের উপযোগী করে গড়ে তুলতে গিয়ে হযরত মুহাম্মদ(স)-কে যে সীমাহীন বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করতে হয়েছে, তাকেও একটা অলৌকিক ব্যাপার ছাড়া আরা কিছুই বলা চলে না।
কাজেই আরবদের এই বৈশিষ্ট্যেগুলো যে পর্যন্ত সামনে না রাখা হবে, সে পর্যন্ত হযরত মুহামামদ(স)- এর নেতৃত্বে সম্পাদিত বিশাল সংস্কার কার্যকে কিছুতেই উপলব্ধি করা যাবে না।এই কওমটির সংশোধনের পথে যে সমস্ত জটিলতার অসুবিধা বর্তমান ছিল, তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্যও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আমরা এখানে বিবৃত করছি। আরবরা ছিল একটা নিরেট অশিক্ষিত জাতি।খোদার সত্তা ও গুণাবলী সম্পর্কিতজ্ঞান, নবুয়্যাতের স্বরূপ ও গুরুত্ব, ওহীর তাৎপর্য, আখিরাত সম্পর্কিত ধারণা, ইবাদতের অর্থ ইত্যাদি কোনো বিষয়ই তারা ওয়াকিফহাল ছিল না।পরন্ত তারা বাপ-দাদার আমল থেকেই প্রচলিত রীতিনীতি ও রসম রেওয়াজের অত্যন্ত অন্ধ অনুসারী ছিল এবং তা থেকে এক ইঞ্চি পরিমাণ দূরে সরতেও প্রস্তুত ছিল না। অথচ ইসলামের যাবতীয় শিক্ষাই ছিল তাদের এই পৈত্রিক ধর্মের সম্পূর্ণ বিপরীত। অন্যদিকে শির্ক থেকে উদ্ভূত সকল মানসিক ব্যাধিই তাদের মধ্যে বর্তমান ছিল। অহংকার ও আত্মম্ভরিতার ফলে তাদের বিবেক-বুদ্ধি হয়ে পড়েছিল প্রায় নিস্ক্রিয়।পারস্পরিক লড়াই-ঝগড়া তাদের একটা জাতীয় বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছিল। এ জন্যে শান্ত মস্তিষ্কে ও গভীরভাবে কোনো কিছু চিন্তা করা তাদের পক্ষে সহজতর ছিল না।তাদের কিছু ভাবতে হলে তা যুদ্ধ-বিগ্রহের দৃষ্টিকোণ থেকেই ভাবতো, এর বাইরে তাদের আর কিছু যেন ভাববারই ছিল না।সাধারণভবে দস্যুবৃত্তি,লুটতরাজ ইত্যাদি ছিল তাদের জীবিকা নির্বাহের উপায়।এ থেকে সহজেই আন্দাজ করা চলে যে,হযরত মুহাম্মদ(স)-এর দাওয়াত তাদের ভেতর কী প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। তিনি যখন তাদের কে ইসলামের দিকে আহ্বান জানান, তখন তাদের কাছে তা মনে হয়েছিল একটি অভিনব দুর্বোধ্য ব্যাপার। তারা বাপ-দাদার আমল থেকে যে সব রসম-রেওয়াজ পালনে অভ্যস্ত, যে সব চিন্তা-খেয়াল তারা মনের মধ্যে পোষণ করেছিল -এ দাওয়াত ছিল তার সম্পূর্ণ বিপরীত। এ দাওয়াতের মূল কথা ছিল : লড়াই-ঝগড়া বন্ধ করো, শান্তিতে বসবাস করো,দস্যুবৃত্তি ও লুটতরাজ থেকে বিরত থাকো, বদভ্যাস ও ধ্বংসাত্মক চিন্তাধারা পরিহার করো, সর্বোপরি জীবিকার জন্যে হারাম পন্থা ত্যাগ করো। স্পষ্টতই বোঝা যায়,এ ধরণের একটি সর্বাত্মক বিপ্লবী পয়গামকে কবুল করা তাদের পক্ষে কত কঠিন ব্যাপার ছিল।
মোটকথা, তৎকালীন দুনিয়া অবস্থা, আরব দেশের বিশেষ পরিস্থিতি এবং সংশ্লিষ্ট জাতির স্বভাব-প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য-বিশেষত্ব -এর কোন জিনিসই ইসলামী আন্দোলনের পক্ষে অনুকূল ছিল না।কিন্তু যখন এর ফলাফল প্রকাশ পেলো,তখনই স্পষ্ট বোঝা গেল :
“বজ্রের ধ্বনি ছিল সেথবা ছিল সে ‘সওতে হাদী’
দিল যে কাঁপায়ে আরবের মাটি রাসূল সত্যবাদী।
জাগালো সে এক নতুন লগ্ন সকলের অন্তরে,
জাগায়ে গেল সে জনতাকে চির সুপ্তির প্রান্তরে!
সাড়া পড়ে গেল চারদিকে এই সত্যের পয়গামে,
হলো মুখরিত গিরি-প্রান্তর চির সত্যের নামে।”
বস্তুত এটই ছিল ইসরামী আন্দোলনের সবচেয়ে বড় মু’জিজা। এই মু’জিজার কথা যখন উত্থাপিত হয়, তখন স্বভবতই হযরত মুহাম্মদ(স)- জীবনধারা আলোচনা এবং তার পেশকৃত পয়গামকে নিকট থেকে উপলব্ধিকরার জন্যে প্রতিটি উৎসুক মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে।পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে এই বিষয়টি আমরা পাঠকদের সামনে তুলে ধরবার চেষ্টা করবো।
মূল:আবু সলীম মুহাম্মদ আবদুল হাই
অনুবাদ: মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান
ইসলামী আন্দোলনের প্রাক্কালে দুনিয়ার অবস্থা :-
ইসলাম মানুষের কাছে যে দাওয়াত পেশ করেছে, তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বুনিয়াদ হচ্ছে তাওহীদ। কিন্তু এই তাওহীদের আলো থেকেই তখনকার আরব উপদ্বীপ তথা সমগ্র দুনিয়া ছিল বঞ্চিত।তৎকালীন মানুষের মনে তাওহীদ সম্পর্কে সঠিক কোন ধারণাই বর্তমান ছিল না।এ কথা সত্যি যে হযরত মুহাম্মদ (স) এর আগেও খোদার অসংখ্য নবী দুনিয়ায় এসেছেন এবং প্রতিটি মানব সমাজের কাছেই তারা তাওহীদের পয়গাম পেশ করেছেন।কিন্তু মানুষের দুর্ভাগ্য এই যে, কালক্রমে এই মহান শিক্ষা বিস্মৃত হয়ে সে নিজেরই ইচ্ছা-প্রবৃত্তির দাসত্বে লিপ্ত হয়ে পড়ে এবং তার ফলে চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-উপগ্রহ,দেব-দেবী, নদী-সমুদ্র, পাহপড়-পর্বত, জ্বিন-ফেরেশতা, মানুষ-পশু ইত্যাকার অনেক বস্তুকে নিজের উপাস্য বা মাবুদের মধ্যে শামিল করে নেয়।এভাবে মানুষ এ খোদার নিশ্চিত বন্দেগীর পরিবর্তে অসংখ্য মাবুদের বন্দেগীর আবর্তে জড়িয়ে পড়ে।
রাজনৈতিক দিক থেকে তখন পারস্য ও রোম এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি বর্তমান ছিলো । পারস্যের ধর্মমত ছিলো অগ্নিপূজা (মাজুসিয়াত) । এর প্রতিপত্তি ছিলো ইরাক থেকে ভারতের সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত। আর রোমের ধর্ম ছিলো খ্রিষ্টবাদ(ঈসাইয়াত)।এটি গোটা ইউরোপ ,এশিয়া ও আফ্রিকাকে পরিবেষ্টন করে ছিলো। এ দুটি বৃহৎ শক্তি ছাড়া ধর্মীয় দিক থেকে ইহুদী ও হিন্দু ধর্মের কিছুটা গুরুত্ব ছিলো। এরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ এলাকায় সভ্যতার দাবি করত।
অগ্নিপূজা ছাড়া পারস্যে (ইরানে) নক্ষত্রপূজারও ব্যাপক প্রচলন ছিলো। সেই সঙ্গে রাজা-বাদশা ও আমির-ওমরাগণ ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রজাদের খোদা ও দেবতার আসনে অধিষ্ঠিত ছিলো। তাদেরকে যথারীতি সিজদা করা হত এবং তাদের খোদায়ীর প্রশস্তিমূলক সংগীত পরিবেশন করা হত।মোট কথা,সারা দুনিয়া থেকেই তাওহীদের ধারণা বিদায় নিয়েছিলো।
রোম সাম্রজ্য
গ্রীসের পতনের পর রোম সাম্রাজ্যকেই তখন দুনিয়ার সবচেয়ে সেরা শক্তি বলে বিবেচনা করা হত। কিন্তু ঈসায়ী ষষ্ঠ শতকের শেষভাগে এই বৃহৎ সাম্রাজ্যই অধঃপতনের শেষ প্রান্তে এসে উপনীত হয়। রাষ্ট-সরকারের অব্যাবস্থা,শত্রুর ভয়,অভ্যন্তরীন অশান্তি ,নৈতিকতার বিলুপ্তি, বিলাসিতার আতিশয্য-এক কথায় তখন এমন কোন দুষ্কৃতি ছিলো না ,যা লোকেদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করেনি। ধর্মীয় দিক থেকে তো কিছু লোক নক্ষত্র ও দেবতার কল্পিত মূতির পূজা-উপাসনায় লিপ্ত ছিলোই;কিন্তু যারা ঈসার ধর্মের অনুসারী বলে নিজেদের দাবি করত, তারাও তাওহীদের ভাবধারা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্যুত হয়ে পড়েছিলো। তারা হযরত ঈসা(আঃ) ও মরিয়মের খোদায়ী মর্যাদায় বিশ্বাসী ছিলো। পরন্ত তারা অসংখ্য ধর্মীয় ফির্কায় বিভক্ত হয়ে পড়েছিলো এবং পরস্পর লড়াই-ঝগড়ায় লিপ্ত থাকতো। তাদের মধ্যে কবর পূজার ব্যাপক প্রচলন ছিলো। পাদ্রীদের তারা সিজদা করত। পোপ ও বিভিন্ন পর্যায়ের ধর্মীয় পদাধিকারীগণ বাদশাহী,এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে খোদায়ী ক্ষমতা পর্যন্ত করায়ত্ত করে রেখেছিলো। হারাম ও হালালের মাপকাঠী তাদের হাতেই নিবদ্ধ ছিলো। তাদের কথাকে ‘খোদায়ী আইন’ বলে গণ্য করা হত। পাশাপাশি সংসারত্যাগ বা সন্ন্যাস ব্রতকে ধার্মিকতার উচ্চাদর্শ বলে মনে করা হতো এবং সকল প্রকার আরাম আয়েশ থেকে দেহকে মুক্ত রাখাই শ্রেষ্ঠ ইবাদত বলে বিবেচিত হতো।
ভারতবর্ষ
ধর্মীয় দিক থেকে ভারতে তখন‘পৌরাণিক যুগ’ বিদ্যমান ছিলো। ভারতের ধর্মীয় ইতিহাসে এই যুগটিকে সবচেয়ে অন্ধকার যুগ বলে গণ্য করা হয়। কারণ এ যুগে ব্রাহ্মণ্যবাদ পুনরায় প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিলো এবং বৌদ্ধদেরকে প্রায় নির্মূল করে দেয়া হয়েছিলো। এ যুগে শির্কের চর্চা মাত্রাতিরিক্ত রকমে বেড়ে গিয়েছিলো। দেবতাদের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে ৩৩ কোটি পর্যন্ত পৌঁছেছিলো। কথিত আছে যে,বৈদিক যুগে কোন মূর্তি পূজার প্রচলন ছিলনা। কিন্তু এ যুগে মূর্তিপূজার ব্যাপক প্রচলন ঘটেছিলো। মন্দিরের পুরোহিতগণ অনৈতিকতার এক জীবন্ত প্রতীক। সরল প্রাণ লোকেদের শোষাণ ও লুন্ঠন করাই ছিল তাদের প্রধান কাজ। সে যুগে বর্ণবাদ বা জাতিভেদ প্রথার বৈষম্য চরমে পৌছেছিল। এর ফলে সামাজিক শৃংখলা ও ব্যাবস্থাপনা ধ্বংস হয়েছিল। সমাজপতিদের খেয়াল-খুশি মতো আইন কানুন তৈরি করে নেয়া হয়েছিল বিচার ইনসাফকে সম্পূর্ণরুপে হত্যা করা হয়েছিল। বংশ-গোত্রের দৃষ্টিতে লোকেদের মর্যাদা নিরুপন করা হতো। সাধারণ্যে মদপানের ব্যাপক প্রচলন ঘটেছিলো। তবে খোদা প্রাপ্তির জন্য বন-জঙ্গল ও পাহাড়-পর্বতে জীবন কাটানো কে অপরিহার্য মনে করা হতো। কুসংস্কার ও ধ্বংসাত্নক চিন্তাধারা চরমে পৌছেছিলো। ভূত প্রেত , শুভাশুভ গণন এ ভবিষ্যৎ কথনে বিশ্বাস গোটা মানব জীবনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো। যে কোন অদ্ভুত জিনিসকেই ‘খোদা’ বলে গণ্য করা হতো। যে কোন অস্বাভাবিক বস্তুর সামনে মাথা নত করাই ধর্মীয় কাজ বলে বিবেচিত হতো। দেব-দেবী ও মূর্তির সংখ্যা গণনা তো দূরের কথা , তা আন্দাজ অনুমানেরও সীমা অতিক্রম করেছিলো। পূজারিণী ও দেবদেবীদের নৈতিক চরিত্র অত্যন্ত লজ্জাকর অবস্থায় উপনীত হয়েছিলো। ধর্মের নামে সকল প্রকার দুষ্কর্ম ও অনৈতিকতাকে সর্মথন দেয়া হতো। এক এক জন নারী একাধিক পুরুষকে স্বামীরুপে গ্রহণ করতো। বিধবা নারীকে আইনের বলে সকল প্রকার সুখ সম্ভোগ থেকে জীবনভর বঞ্চিত করে রাখা হতো। এই ধরনের জুলুম মূলক সমাজরীতির ফলে জীবন- নারী তার মৃত স্বামীর জ্বলন- চিতায় ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুবরণ করতে পর্যন্ত স্বীকৃত হতো। যুদ্ধে হেরে যাবার ভয়ে বাপ,ভাই ও স্বামী তাদের কন্যা , ভগ্নি ও স্ত্রীকে স্বহস্থে হত্যা করে ফেলতো এবং এতে তারা অত্যন্ত গর্ববোধ করতো। নগ্ন নারী ও নগ্ন পুরুষের পূজা করাকে পূণ্যের কাজ বলে গণ্য করতো। পূজা পার্বণ উপলক্ষে মদ্যপান করে তারা নেশায় চুর হয়ে যেত। মোদ্দাকথা, ধর্মাচরণ, নৈতিকতা ও সামাজিকতার দিক দিয়ে খোদার এই ভূখন্ডটি শয়তানের এক নিকৃষ্ট লীলাভূমিতে পরিণত হয়েছিলো।
ইহুদী
আল্লাহর দ্বীনের অনুসারী হিসেবে কোনো সংস্কার-সংশোধন যদি প্রত্যাশা করা যেতো, তাহলে ইহুদীদের কাছ থেকেই করা যেতে পারতো। কিন্তু তাদের অবস্থাও তখন অধঃপতনের চরম সীমায় পৌছে গিয়েছিলো। তারা তাদের দীর্ঘ ইতিহাসে এমন সব গুরুতর অপরাধ করেছে যে, তাদের পক্ষে কোনো সংস্কার মূলক কাজ করাই সম্ভব ছিলো না। তাদের মানসিক অবস্থা অত্যন- শোচনীয় আকার ধারণ করেছিলো। ফলে তাদের ভেতর কোনো নবীর আগমন ঘটলে তাঁর কথা শুনতে পর্যন্ত তারা প্রস্তুত ছিলো না। এজন্যে কতো নবীকে যে তারা হত্যা করেছে তার ইয়ত্তা নেই। তারা এরুপ ভ্রান্ত ধারণায় নিমজ্জিত ছিলো যে, খোদার সাথে তাদের একটি বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে ; সুতরাং কোনো অপরাধের জন্যেই তিনি তাদের শাস্তি দেবেন না। তারা এ-ও ধারণা করতো যে, বেহেস্তের সকল সুখ-সম্ভোগ শুধু তাদের জন্যেই নির্দ্দিষ্ট করে রাখা হয়েছে।নবুয়্যাত ও রিসালাতকে তারা নিজেদের মীরাসী সম্পত্তি বলে মনে করতো। তাদের আলেম সমাজ দুনিয়া-পুজা ও যুগ-বিভ্রান্তিতে চরমভাবে লিপ্ত হয়ে পড়েছিলো। বিত্তশালী ও শাসক সম্প্রদায়ের মনোতুষ্টির জন্যে সবসময় তারা ধর্মীয়বিধি-বিধানে হ্রাস-বৃদ্ধি করতে থাকতো। খোদায়ী বিধান সমূহের মধ্যে যেগুলো অপেক্ষাকৃত সহজতর এবং তাদের মর্জি মাফিক,সে গুলোই তারা অনুসরণ করতো;পক্ষান্তরে যেগুলো কঠিন ও অপছন্দনীয় ,সেগুলো অবলীলাক্রমে বর্জন করতো।
পরস্পর যুদ্ধ-বিগ্রহ ও খুন খারাবী করা তৎকালীন ইহুদীদের একটা সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়েছিলো। ধন-মালের লালসা তাদেরকে সীমাহীনভাবে অন্ধ করে তুলেছিলো এবং এদিক থেকে কিছুমাত্র ক্ষতি হতে পারে, এমন কোন কাজ করতেই তারা প্রস্তুত ছিলো না। এর ফলে তাদের নৈতিক চরিত্র অত্যন্ত দূর্বল হয়ে পড়েছিল। তাদের ভেতরে মুশরিকদের মত মূর্তিপূজাও প্রভাব বিস্তার করেছিল। যাদু-টোনা,তাবিজ-তুমার, আমল-তদবীর ইত্যাদি অসংখ্য প্রকার কুপ্রথা তাদের মধ্যে ঢুকে পড়েছিলো এবং তওহীদের সঠিক ধারণাকে তা নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিলো। এমন কি,যখন আল্লাহর শেষ নবী তওহীদের সঠিক দাওয়াত পেশ করেন। তখন এই ইহুদীরাই মুসলমানদের চেয়ে আরব মুশরিকদেরকে উত্তম বলে ঘোষণা করেন।
আরব দেশের অবস্থা
দুনিয়ার ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অবস্থা পর্যালোচনার পর এবার খোদ আরব দেশের প্রতি আমরা দৃষ্টিপাত করবো। কারণ, এই গুরুত্বপূর্ণ ভূ-খণ্ডেই আল্লাহর সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী তার আন্দোলনের সূত্রপাত করেন এবং এখানকার পরিস্থিতিই তাকে সর্বপ্রথম মুকাবেলা করতে হয়।
আরবের একটি বিরাট অংশ- কোরা উপত্যকা, খায়বার ও ফিদাকে তখন বেশির ভাগ বাসিন্দাই ছিল ইহুদী। খোদ মদীনায় পর্যন্ত ইহুদীদের আদিপত্য কায়েম ছিল। বাকী সারা দেশে পৌত্তলিক রীতি-রেওয়াজ প্রচলিত ছিল। লোকেরা মূতি,পাথর ,নক্ষত্র,ফেরেশতা, জ্বিন প্রভৃতির পূজা-উপাসনা করতো ।অবশ্য এক আল্লাহর ধারণা তখনও কিছুটা বর্তমান ছিল। তবে তা শুধু এই পর্যন্ত যে, লোকেরা তাকে খোদাদের খোদা বা ‘সবচাইতে বড় খোদা’ বলে মনে করত। আর এই আকিদাও এতটা দুর্বল ছিল যে কার্যত তারা নিজেদের মনগড়া ছোটখাটো খোদাগুলোর পূজা উপাসনায়ই লিপ্ত থাকতো। তারা বিশ্বাস করতো যে, মানুষের দৈনন্দিন জীবনে এই সব ছোট খাটো খোদার প্রভাবই কার্যকর হয়ে থাকে। তাই বাস্তব ক্ষেত্রে তারা এগুলেরই পূজা উপাসনা করতো। এদের নামেই মানত মানতো ও কুরবানী করতো এবং এদের কাছেই নিজ নিজ বাসনা পূরণের আবেদন জানাতো। তারা এও ধারণা করতো এসব ছোট খাটো খোদাকে সন্তষ্ট করলেই আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তষ্ট হবেন।
এ ভ্রান্ত লোকেরা ফেরেস্থতাদেরকে খোদার পুত্র কন্যা বলে আখ্যা দিত। জ্বীনদের কে খোদার ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং খোদায়ীর অন্যতম শরিকদার বলে ধারণা করতো এবং এই কারণে তারা তাদের পূজা-উপাসনা করতো, তাদের কাছে সাহায্য কামনা করতো। যে সব শক্তিকে এরা খোদায়ীর শরিকদার বলে মনে করতো, তাদের মূর্তি বানিয়ে যথারীতি পূজা-উপাসনাও করতো। মূর্তি পূজার এতোটা ব্যাপক প্রচলন ঘটেছিল যে, কোথাও কোন সুন্দর পাথর খন্ড দৃষ্টি গোচর হলেই তারা তার পূজা-উপাসনা শূরু করে দিত। এমনকি, একান্তই কিছু না পাওয়া গেলে মাটির একটা স্তুপ বানিয়ে তার উপর কিছুটা ছাগ-দুগ্ধ ছিটিয়ে দিত এবং তার চারদিক প্রদক্ষিণ করতো।
মোট কথা, পূজা-উপাসনার জন্য আরবরা অসংখ্য প্রকার মূর্তি নির্মান করে নিয়েছিল। এসকল মূর্তির পাশাপাশি তারা গ্রহ নক্ষত্রেরও পূজা করতো। বিভিন্ন গোত্রের লোকেরা বিভিন্ন নক্ষত্রের পূজা করতো। এর ভিতর সূর্য ও চন্দ্রের পূজাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তারা জ্বিন-পরী এবং ভূত-প্রেতেরও পূজা করতো। এদের সম্পর্কে নানা প্রকার অদ্ভূত কথা তাদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। এছাড়া মুশরিক জাতি গুলোর মধ্যে আর যে সব কুসংস্কারের প্রচলন দেখা যায়,সেসব ও এদের মধ্যে বর্তমান ছিল।
এহেন ধর্মীয় বিকৃতির সাথে সাথে পারস্পারিক লড়াই-ঝগড়া আরবদের মধ্যে একটা সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়েছিল। মামুলি বিষয়াদি নিয়ে তাদের মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ শুরু হয়ে যেতো এবং বংশ পরম্পরায় তার জের চলতে থাকতো। জুয়াখেলা ও মদ্যপানে তারা এতটা অভ্যস্থ হয়ে পড়েছিল যে, তখনকার দিনে আর কোন জাতিই সম্ভবত তাদের সমকক্ষ ছিল না।মদের প্রশস্তি এবং তার সাথে সংশ্লিষ্ট দুষ্কর্মগুলো প্রসংসায় তাদের কাব্য-সাহিত্য পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। এছাড়া সুদী কারবার,লুটপাট,চৌর্যবৃত্তি,নৃশংসতা রক্তপাত, ব্যভিচার, এবং এ জাতীয় অন্যান্য দুষ্কর্ম তাদেরকে প্রায় মানবরুপি পশুতে পরিণত করেছিল।আপন কন্যা সন্তানকে তারা অপয়া ভেবে জীবন্ত দাফন করতো। নির্লজ্জ আচরণে তারা এতদূর পর্যন্ত পৌঁছেছিল যে, পুরুষ ও নারীর একত্রে নগ্নাবস্থায় কাবা শরীফ তওয়াফ করাকে তারা ধর্মীয় কাজ বলে বিবেচনা করতো। মোটকথা,ধর্মীয়,নৈতিক,সামাজিক,ও রাজনৈতিক জীবনে তখনকার আরব ভূমি অধঃপতনের চরম সীমায় উপনীত হয়েছিল।
ইসলামী আন্দোলনের জন্যে আরব দেশের বিশেষত্ব
আরব উপদ্বীপ তথা সমগ্র বিশ্বব্যাপী এই ঘোর অমানিশার অবসান ঘটিযে আল্লাহর পথভ্রষ্ট বান্দাদেরকে তারই মনোনীত পথে চালিত করার জন্যে একটি শুভ প্রভাতের যে একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল, এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এই শুভ প্রভাতটির সূচনার জন্যে আল্লাহ তা’আলা সারা দুনিয়ার মধ্যে আরব দেশকে কেন মনোনীত করলেন, প্রসঙ্গত এই কথাটিও আমাদের ভেবে দেখা দরকার।
আল্লাহ তা’আলা হযরত মুহাম্মদ(স)- কে সারা দুনিয়ার জন্যে হেদায়াত ও দিক-নির্দেশনা সর্বশেষ পয়গামসহ পাঠানোর জন্যে মনোনীত করেছিলেন। সুতরাং তার দাওয়াত সমগ্র দুনিয়ায়ই প্রচারিত হবার প্রয়োজন ছিল। স্পষ্টতই বোঝা যায় যে, এই বিরাট কাজের জন্যে কোন এক ব্যক্তির জীবন-কালই যথেষ্ট হতে পারে না।এর জন্যে প্রয়োজন ছিল :আল্লাহর নবী তার নিজের জীবদ্দশায়ই সৎ ও পুণ্যবান লোকদের এমন একটি দল তৈরি করে যাবেন, যারা তার তিরোধানের পরও তার মিশনকে অব্যাহত রাখবেন। আর এই গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্যে যে ধরনের বিশেষত্ব ও গুণাবরীর প্রয়োজন ছিল, তা একমাত্র আরব অধিবাসীদের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি উন্নত মানের এবং বিপুল পরিমানে পাওয়া যেত । উপরন্ত আরবের ভৌগোলিক অবস্থানকে দুনিয়ার জনবসতিপূর্ণ এলাকার প্রায় কেন্দ্রস্থল বলা চলে। এসব কারণে এখান থেকেই নবীজীর দাওয়াত চারদিকে প্রচার করা সবদিক থেকেই সুবিধাজনক ছিল।
এছাড়া আরবী ভাষারও একটি অতুলনীয় বিশেষত্ব ছিল। কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে এই ভাষায় যতটা সহজে ও হৃদয়গ্রাহী করে পেশ করা যেতো, দুনিয়ার অন্য কোন ভাষায় তা সম্ভবপর ছিল না। সর্বোপরি, আরবদের একটা বড়ো সৌভাগ্য ছিল যে, তারা কোনো বিদেশি শক্তির শাসনাধীন ছিল না। গোলামীর অভিশাপে মানুষের চিন্তা ও মানসিকতার যে নিদারুণ অধঃগতি সূচিত এবং উন্নত মানবীয় গুণাবলীরও অপমৃত্যু ঘটে,আরবরা সে সব দোষ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিল। তাদের চারদিকে পারস্য ও রোমের ন্যায় বিরাট দুটি শক্তির রাজত্ব কায়েম ছিল; কিন্তু তাদের কেউই আরবদের কে গোলামীর শৃঙ্খলে আবদ্ধ করতে পারেনি ।তারা ছিল দুর্ধর্ষ প্রকৃতির বীর জাতি; বিপদ-আপদকে তারা কোনোদিন পরোয়া করতো না। তারা ছিল স্বভাবগত বীর্যবান;যুদ্ধ-বিগ্রহকে তারা মনে করতোএকটা খেল-তামাসা মাত্র । তারা ছিল অটল সংকল্প আর স্বচ্ছ দিলের অধিকারী। যে কথা তাদের মনে জাগতো,তা-ই তারা মুখে প্রকাশ করতো। গোলাম ও নির্বোধ জাতিসমূহের কাপুরুষতা ও কপট মনোবৃত্তির অভিশাপ থেকে তারা ছিল সম্পূর্ণ মুক্ত। তাদের কাণ্ডজ্ঞান,বিবেক-বুদ্ধিও মেধা-প্রতিভা ছিল উন্নত মানের। সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ কথাও তারা অতি সহজে উপলব্ধি করতে পারতো। তাদের স্মরণ শক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর; এক্ষেত্রে সমকালীন দুনিয়ার কোনো জাতিই তাদের সমকক্ষ ছিল না।তারা ছিল উদারপ্রাণ, স্বাবলম্বী ও আত্ম-মর্যাদা সম্পূর্ণ জাতি। করো কাছে মাথা নত করতে তারা আদৌ অভ্যস্ত ছিল না। সর্বোপরি, মরুভূমির কঠোর জীবন-যাত্রায় তারা হয়ে ওঠেছিল নিরেট বাস্তববাদী মানুষ। কোন বিশেষ পয়গাম কবুল করার পর বসে বসে তার প্রশস্তি কীর্তন করা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না;বরং সে পয়গামকে নিয়ে তারা মাথা তুলে দাঁড়াতো এবং তার পিছনে তাদের সমগ্র শক্তি-সামর্থ্য নিয়োজিত করতো।
আরবদের সংশোধনের পথে বাধা
আরব দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, তার শক্তিশালী ভাষা এবং তার বাসিন্দাদের এসব বৈশিষ্ট্যের কারণেই আল্লাহ তা’আলা তাঁর সর্বশেষ নবীকে এই জাতির মধ্যে প্রেরণ করার সিদ্ধান্ত করেন, সন্দেহ নেই।কিন্তু এই অদ্ভূত কওম কে সংশোধন করতে গিয়ে খোদ হযরত মুহাম্ম্দ (স)-কে যে বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়, তার গুরুত্বও কোনো দিক দিয়ে কম ছিল না। আগেই বলেছি, কোনো কাজের সঠিক মূল্যায়ন করতে হলে সে কাজটির চারদিকের অবস্থা ও পরিবেশের কথা বিচার করা প্রয়োজন ।এই দৃষ্টিতে বিচার করলে আরব ভূমির সেই ঘনঘোর অন্ধকার যুগে এ ইসলামী আন্দোলনের সূচনা ও তার সাফল্যকে ইতিহাসের এক নজিরবিহীন কীর্তি বলে অভিহিত করতে হয়। আর একারণেই আরবদের ন্যায় একটি অদ্ভূত জাতিকে দুনিয়ার নেতৃত্বের উপযোগী করে গড়ে তুলতে গিয়ে হযরত মুহাম্মদ(স)-কে যে সীমাহীন বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করতে হয়েছে, তাকেও একটা অলৌকিক ব্যাপার ছাড়া আরা কিছুই বলা চলে না।
কাজেই আরবদের এই বৈশিষ্ট্যেগুলো যে পর্যন্ত সামনে না রাখা হবে, সে পর্যন্ত হযরত মুহামামদ(স)- এর নেতৃত্বে সম্পাদিত বিশাল সংস্কার কার্যকে কিছুতেই উপলব্ধি করা যাবে না।এই কওমটির সংশোধনের পথে যে সমস্ত জটিলতার অসুবিধা বর্তমান ছিল, তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্যও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আমরা এখানে বিবৃত করছি। আরবরা ছিল একটা নিরেট অশিক্ষিত জাতি।খোদার সত্তা ও গুণাবলী সম্পর্কিতজ্ঞান, নবুয়্যাতের স্বরূপ ও গুরুত্ব, ওহীর তাৎপর্য, আখিরাত সম্পর্কিত ধারণা, ইবাদতের অর্থ ইত্যাদি কোনো বিষয়ই তারা ওয়াকিফহাল ছিল না।পরন্ত তারা বাপ-দাদার আমল থেকেই প্রচলিত রীতিনীতি ও রসম রেওয়াজের অত্যন্ত অন্ধ অনুসারী ছিল এবং তা থেকে এক ইঞ্চি পরিমাণ দূরে সরতেও প্রস্তুত ছিল না। অথচ ইসলামের যাবতীয় শিক্ষাই ছিল তাদের এই পৈত্রিক ধর্মের সম্পূর্ণ বিপরীত। অন্যদিকে শির্ক থেকে উদ্ভূত সকল মানসিক ব্যাধিই তাদের মধ্যে বর্তমান ছিল। অহংকার ও আত্মম্ভরিতার ফলে তাদের বিবেক-বুদ্ধি হয়ে পড়েছিল প্রায় নিস্ক্রিয়।পারস্পরিক লড়াই-ঝগড়া তাদের একটা জাতীয় বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছিল। এ জন্যে শান্ত মস্তিষ্কে ও গভীরভাবে কোনো কিছু চিন্তা করা তাদের পক্ষে সহজতর ছিল না।তাদের কিছু ভাবতে হলে তা যুদ্ধ-বিগ্রহের দৃষ্টিকোণ থেকেই ভাবতো, এর বাইরে তাদের আর কিছু যেন ভাববারই ছিল না।সাধারণভবে দস্যুবৃত্তি,লুটতরাজ ইত্যাদি ছিল তাদের জীবিকা নির্বাহের উপায়।এ থেকে সহজেই আন্দাজ করা চলে যে,হযরত মুহাম্মদ(স)-এর দাওয়াত তাদের ভেতর কী প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। তিনি যখন তাদের কে ইসলামের দিকে আহ্বান জানান, তখন তাদের কাছে তা মনে হয়েছিল একটি অভিনব দুর্বোধ্য ব্যাপার। তারা বাপ-দাদার আমল থেকে যে সব রসম-রেওয়াজ পালনে অভ্যস্ত, যে সব চিন্তা-খেয়াল তারা মনের মধ্যে পোষণ করেছিল -এ দাওয়াত ছিল তার সম্পূর্ণ বিপরীত। এ দাওয়াতের মূল কথা ছিল : লড়াই-ঝগড়া বন্ধ করো, শান্তিতে বসবাস করো,দস্যুবৃত্তি ও লুটতরাজ থেকে বিরত থাকো, বদভ্যাস ও ধ্বংসাত্মক চিন্তাধারা পরিহার করো, সর্বোপরি জীবিকার জন্যে হারাম পন্থা ত্যাগ করো। স্পষ্টতই বোঝা যায়,এ ধরণের একটি সর্বাত্মক বিপ্লবী পয়গামকে কবুল করা তাদের পক্ষে কত কঠিন ব্যাপার ছিল।
মোটকথা, তৎকালীন দুনিয়া অবস্থা, আরব দেশের বিশেষ পরিস্থিতি এবং সংশ্লিষ্ট জাতির স্বভাব-প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য-বিশেষত্ব -এর কোন জিনিসই ইসলামী আন্দোলনের পক্ষে অনুকূল ছিল না।কিন্তু যখন এর ফলাফল প্রকাশ পেলো,তখনই স্পষ্ট বোঝা গেল :
“বজ্রের ধ্বনি ছিল সেথবা ছিল সে ‘সওতে হাদী’
দিল যে কাঁপায়ে আরবের মাটি রাসূল সত্যবাদী।
জাগালো সে এক নতুন লগ্ন সকলের অন্তরে,
জাগায়ে গেল সে জনতাকে চির সুপ্তির প্রান্তরে!
সাড়া পড়ে গেল চারদিকে এই সত্যের পয়গামে,
হলো মুখরিত গিরি-প্রান্তর চির সত্যের নামে।”
বস্তুত এটই ছিল ইসরামী আন্দোলনের সবচেয়ে বড় মু’জিজা। এই মু’জিজার কথা যখন উত্থাপিত হয়, তখন স্বভবতই হযরত মুহাম্মদ(স)- জীবনধারা আলোচনা এবং তার পেশকৃত পয়গামকে নিকট থেকে উপলব্ধিকরার জন্যে প্রতিটি উৎসুক মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে।পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে এই বিষয়টি আমরা পাঠকদের সামনে তুলে ধরবার চেষ্টা করবো।
0 comments:
Thanks for Comment