জেনে নিন কীভাবে ভুঁড়ি কমাবেন !

কখন ভুঁড়ি
কারো ভুঁড়ি হয়েছে এমন কথা বলার আগে কোনো মানুষকে কখন মোটা বলব, সেটা বরং আগে জেনে নিই। বডি মাস ইন্ডেক্স বা বিএমআই নামে একটা কথা আছে, যার ওপর ভিত্তি করে কাউকে রোগা বা মোটা বলা হয়। কীভাবে সেটা মাপা হয়? কোনো ব্যক্তির ওজন ও উচ্চতা মাপা হয় কিলোগ্রাম ও মিটারে। এই ওজনকে উচ্চতার বর্গফল দিয়ে ভাগ করলে ভাগফলই হবে বিএমআই। বিএমআই ১৮ থেকে ২৫ হলে তিনি আদৌ মোটা নন, বরং তাকে বলা যায় স্বাভাবিক। বিএমআই ২৫ থেকে ৩০-এর মধ্যে হলে তারা সামান্য মোটা, যাদের এটি ৩০ থেকে ৩৫ তারা মাঝারি মোটা, আর যাদের বয়স ৩৫-এর উপরে তারা ভীষণ মোটা। ধরা যাক কারো ওজন ৫০ কিলোগ্রাম, উচ্চতা ১.৫ মিটার। তার বিএমআই হলো ৫০ গু ১.৫ ক্ম ১.৫ = ৫০ গু ২.৫ = ২০। এই ব্যক্তি মোটা নন মোটেই, কেননা এর বডি মাস ইন্ডেক্স স্বাভাবিক মাত্রার (১৮-২০) মধ্যে। যার বিএমআই যেমন তার ভুঁড়ির মাপও সে রকম।

এত অঙ্ক কষতে না পারলে একটা ফিতে নিয়ে কোমরের বেড়টা একবার মেপে নিন। মহিলাদের বেড় ৮০ সেমি বা ৩১.৫ ইঞ্চি ছাড়িয়ে গেলে অবশ্যই সাবধান হতে হবে। আর ৮৮ সেমি বা ৩৪.৬ ইঞ্চি পেরিয়ে গেলে সেই মহিলা রীতিমতো ভুঁড়িযুক্তা। বেঁটে পুরুষের ক্ষেত্রে মাপটা হবে ৯৪ সেমি বা ৩৭ ইঞ্চি এবং লম্বাদের ক্ষেত্রে ১০২ সেমি বা ৪০.২ ইঞ্চি।

ভূরিভোজ থেকে ভুঁড়ি
আমাদের খাবারের মূল উপাদান ৬টি- প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট, খনিজ পদার্থ, ভিটামিন ও পানি। এই উপাদানগুলো পুড়ে (অক্সিডেশন) তৈরি হয় দেহের চালিকাশক্তি- ক্যালরি। অতিরিক্ত ক্যালরি গ্রহণ মানেই বাড়তি ফ্যাট, নিটফল ভুঁড়ি। ক্যালরি গ্রহণ-বর্জনে সামঞ্জস্য না থাকলেই সমূহ বিপদ। কাজেই ভুঁড়ি এড়াতে ভূরিভোজ বাদ দেয়াই মঙ্গল। মস্তিষেকর হাইপোথ্যালামাস অঞ্চলটি খিদে পাওয়া ও পরিতৃপ্ত হওয়ার ব্যাপার- দুটিই নিয়ন্ত্রণ করে। নিউরোপেপটাইড রাসায়নিকের সাহায্যে স্বাদ-বর্ণ-গন্ধে হাইপোথ্যালামাসের অ্যাপেটাইট সেন্টার উত্তেজিত হয়। এর ফলেই আমরা খাদ্য গ্রহণ করি। আবার খিদে পূরণ হলে ভেগাস নার্ভের সাহায্যে খবর পৌঁছায় হাইপোথ্যালামাসের পরিতৃপ্তি কেন্দ্র বা স্যাটেইটি সেন্টারে। তখনই আমরা খাদ্যগ্রহণ থেকে বিরত হই। এই দুই সেন্টারের কাজের মধ্যে সামঞ্জস্য বা ব্যালান্স আছে। কোনো কারণে এই ব্যালান্স নষ্ট হলে হঠাৎ করে খিদে বাড়তে পারে। খুব বেশি ভোজনপ্রবণদের ক্ষেত্রে এমনটা ঘটতে পারে।

পরিশ্রম না করা
কুলি-কামিন কিংবা মুটে-মজুরদের ভুঁড়ি হয় না। কারণ তারা ঘাম ঝরিয়ে পরিশ্রম করে। ভুঁড়িবিভ্রাট মধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্তদের সমস্যা। সারাদিন কত কিছুই যে খাই আমরা অথচ এক কিলোমিটারও হাঁটি না। দেহে সঞ্চিত বাড়তি ক্যালরি তা হলে খরচ হবে কীভাবে! এই যান্ত্রিক যুগে শিশুরাও স্কুল, টিচার, পড়াশোনা আর টিভি নিয়ে দিন কাটায়, নানা ধরনের ফাস্ট ফুড খায়, মেদ বাড়ে তাদেরও।

 ভুঁড়ি থেকে বিপত্তি হৃদরোগের আশঙ্কা
 ভুঁড়ি বৃদ্ধির সঙ্গে হৃদরোগের সম্পর্ক বড়ই গভীর। আগে মনে করা হতো ৪০ বছর বয়সের আগে হৃদরোগ হয় না। এখন সে ধারণা পাল্টে গেছে। ২০ বছর বয়সেই কারো মেদবৃদ্ধি শুরু হলে পুরুষদের ক্ষেত্রে ১৩ বছর এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে ৮ বছর আয়ু কমে যায়। ৪০ বছর বয়সে মেদবৃদ্ধি শুরু হলে মহিলা-পুরুষ উভয়েরই আয়ু কমে গড়ে ৬-৭ বছর। এই আয়ুক্ষয়ের মূল কারণ হৃদরোগের ফলে সেই ব্যক্তির মৃত্যু। আমাদের দেহে চর্বি বা মেদের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে লেপটিন প্রোটিন। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, দেহে এই লেপটিনের ঘাটতি দেখা দিলে পেটে ফ্যাট জমে ভুঁড়ি হয়। এই লেপটিনকে ফ্যাট গলানোর ওষুধ হিসেবে দেহে ইনজেকশন করে ঢুকিয়ে মেদবৃদ্ধি কমানোর কথা ভাবছেন বিজ্ঞানীরা।

আমাদের দেহে ফ্যাট সেল বা চর্বি কোষের সংখ্যা বেড়ে গেলেই আমরা মোটা হতে শুরু করি। মাঝারি মাপের ভুঁড়িওয়ালাদের ফ্যাট সেলের সংখ্যা ১ লাখ থেকে বেড়ে ৩-৪ লাখ পর্যন্ত হতে পারে। আবার এমন হতে পারে ফ্যাট সেল সংখ্যায় না বেড়ে আয়তনে বেড়ে গেল। এর ফলে আমাদের বিপাকীয় ক্রিয়ার হার বা বেসাল মেটাবলি রেট (BMR) উল্টোপাল্টা হতে শুরু করে। ফ্যাট সেল বাড়ার ফলে বেড়ে যায় ব্লড ভলিউম এবং কার্ডিয়াক আউটপুট। প্রতি মিনিটে হার্ট বেশি করে রক্ত পাম্প করে ধমনীতে পাঠাতে থাকে। বাড়তে থাকে হার্টের ওজন, আকার-আয়তন। ফ্যাট জমতে থাকে হার্টের মাংসপেশিতেও। মাংসপেশির কোথাও বেশি জমে, কোথাও কম, কোথাওবা একেবারেই না। একে বলে ইকসেন্ট্রিক হাইপারট্রপি অব হার্ট। এর ফলে হার্ট রেট হঠাৎ করে বেড়ে যেতে পারে। শুরু হয় কার্ডিয়াক অ্যারিথমিয়া। এর ফলে হঠাৎ করে মৃত্যুও হতে পারে। হার্টে কোনো অসুখ নেই, রক্তচাপ একদম স্বাভাবিক, তবু ভুঁড়িওয়ালা বা ভুঁড়িযুক্তাদের অতিরিক্ত ফ্যাটের জন্য হঠাৎ করেই হার্টের ওপর চাপ পড়ে হার্ট ফেইলিওর হতে পারে। ফ্যাট তো শুধু ভুঁড়িতে জমে না, সুযোগ পেলেই চলে আসে রক্তস্রোতে। বেড়ে যায় কোলেস্টেরল এবং ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা। এরা রক্তনালিতে জমে প্লেক তৈরি করে। প্লেকের ভেতরটা চর্বিজাতীয় পদার্থ, বাইরে থাকে তন্তুময় কলা বা ফাইবার টিস্যুর স্তর। এই প্লেকগুলো ধীরে ধীরে বড় হযে রক্ত সরবরাহে বাধার সৃষ্টি করে।

ধমনী সরু হওয়ায় রক্তের গতিও কমে যায়। নমনীয়তা হারিয়ে ধমনী পুরু ও শক্ত হয়ে যায়। এই পুরো ব্যাপারটিকে বলে অ্যাথিরোস স্কেলিরোসিস। ধমনীর অবরোধ যত বাড়বে, তত চাপ পড়বে হার্টের ওপর। হার্টকে বেশি পরিমাণ রক্ত পাম্প করে পাঠাতে হবে রক্তনালিতে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে হার্টের পেশি। হার্টের পেশিতে রক্ত সরবরাহ কম হলে অক্সিজেন সরবরাহও কম হবে, দেখা দেবে ইস্কিমিয়া, অ্যানজাইনা এবং শেষে মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন বা হার্ট অ্যাটাক। মোটা মানুষদের কার্ডিয়াক আউটপুট বেড়ে যাওয়ায় রক্তচাপও বাড়ে। ফলে সেরিব্রাল হেমারেজ হয়ে প্যারালাইসিস হতে পারে। থ্রম্বসিস হয়ে মৃত্যুও হতে পারে। ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে কিডনিও। যত বেশি ভুঁড়ি তত বেশি হাঁপ। একটু জোরে হাঁটলেই অনেকের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। হার্টবিট বেড়ে হয় মিনিটে ১৩০-১৪০। মেদবান পুরুষদের মধ্যে

ভুঁড়ি ও ডায়াবেটিস
 যত ভুঁড়ি তত ডায়াবেটিস। দেহের অগ্ন্যাশয় গ্রন্থি থেকে নিঃসরিত ইনসুলিন হরমোন আমাদের রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। এই মাত্রা বেড়ে গেলে যেমন গণ্ডগোল, তেমনি কমে গেলেও। দেহের ইনসুলিন রিসেপটরগুলো ইনসুলিনের মাত্রা ঠিকঠাক রাখে। অতিরিক্ত মোটাদের এই রিসেপটরগুলো ঠিকমতো কাজ না করায় রক্তে ইনসুলিনের তারতম্য ঘটে, কার্বোহাইড্রেট বিপাকে বিঘ্ন ঘটে। অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেট ফ্যাটরূপে দেহে জমে, দেখা দেয় ডায়াবেটিস। এছাড়া রক্তে কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রাও বেড়ে যায়। একসঙ্গে এসব উপসর্গকে বলে সিনড্রম এক্স ডিজিজ।

 ভুঁড়ি থেকে বাত 
যত বয়স বাড়ে ততই কমজোরি হতে থাকে আমাদের হাঁটু জোড়া। সারা দেহের ভার আর বইতে পারে না। এর ওপর যদি হাঁটু দুটোকে বিশাল ভুঁড়ি বহন করতে হয়, তাহলে তো সোনায় সোহাগা! হাঁটুর সন্ধিস্থল অর্থাৎ ই-জয়েন্টের মাসল, লিগামেন্ট, টেন্ডন, কার্টিলেজ সবই ক্ষয়প্রাপ্ত হতে শুরু করে। দেখা দেয় অস্টিওআর্থ্রাইটিস। দেখা দিতে পারে গেঁটে বাত বা রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস এবং গাউটও। ভুঁড়িবাহী ব্যক্তির বেশি বয়সে পায়ে ভেনাস থ্রম্বসিস হয়ে রক্ত সঞ্চালন কমে গিয়ে নানা বিপত্তি হতে পারে। 

সিগারেট ছেড়ে ভুঁড়ি!
 হঠাৎ করে ধূমপান বন্ধ করলে কারো কারো ভুঁড়ি হয়। কেন হয়? সিগারেটের মূল উপাদান নিকোটিন। ৫০০ মিলিগ্রামের সিগারেটে নিকোটিন থাকে প্রায় ১ মিলিগ্রাম। এই নিকোটিনের নানা বদগুণ থাকলেও একটি সুগুণও আছে। সেটি প্যাট অক্সিডেশন অর্থাৎ দেহের চর্বি দহনে সাহায্য করা। ধূমপান হঠাৎ ছেড়ে দিলে নিকোটিনের অভাবে এই ফ্যাট অক্সিডেশন বাধা পেয়ে চর্বি জমতে থাকে পেটে, তৈরি হয় নোয়াপাতি ভুঁড়ি। তবে উপায়? ভুঁড়ির হাত থেকে বাঁচতে কি ধূমপান চালিযে যাবেন? কক্ষনো নয়। ধূমপান ছাড়ুন। ছাড়ুন হাই ক্যালরি ডায়েট। শুরু করুন নিয়মিত হাঁটাহাঁটি ও ফ্রি হ্যান্ড। দেখবেন শরীর আগের মতোই ফিট।

 সিজার করলে ভুঁড়ি বাড়ে?
শরীরে ফ্যাট সেল বেশি থাকায় মহিলারা ভুঁড়িপ্রবণ। অনেক মহিলারই অভিযোগ, বিশেষ করে সিজারে সন্তানের পরই হয়েছে তাদের বেঢপ ভুঁড়ি। সত্যিই কি সিজার করলে মহিলাদের ভুঁড়ি হয়?
 স্বাভাবিক অবস্থায় একজন মহিলার পেটের মাপ গড়ে ২২ থেকে ২৪ ইঞ্চি। পূর্ণ গর্ভাবস্থায় এই মাপ বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৩৬ ইঞ্চি। অর্থাৎ বৃদ্ধি পায় ১২ থেকে ১৪ ইঞ্চি। গর্বে শিশু বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে পেটের পেশি, চর্বি সবই কিছুটা করে বাড়ে। ডেলিভারির পর এই বেড়ে ওঠাটা মেক-আপ হতে পারে না। ৩৬ ইঞ্চি ভুঁড়ি কমে সহজে আর ২২-২৪ ইঞ্চিতে আসতে চায় না, আটকে যায় ২৭-২৮ ইঞ্চিতেই। নিটফল ৪-৬ ইঞ্চি ভুঁড়ি বৃদ্ধি। একটু শরীরচর্চা করলে সহজেই কিন্তু এই বৃদ্ধিকে কমিয়ে ফেলা যায়। সন্তান জন্মের পর মায়ের তাকে নিয়ে ব্যস্ততায় নিজের দিকে আর তাকানোর সময় হয় না। তাছাড়া শারীরিক পরিশ্রম, হাঁটাহাঁটি- এসবের পাট তো অন্তত মাস চার-পাঁচ উঠে যায়। সিজার হলে তো আর কথাই নেই। মায়েরা অন্তত এক মাস বিছানা ছেড়ে নামতেই চান না; ভয় পান, যদি সেলাইয়ের জায়গাটা ছিঁড়ে যায়। তাছাড়া অপারেশনের পর ভালো-মন্দ খাওয়া-দাওয়াও যায় বেড়ে। শরীরে যথেচ্ছ ক্যালরি ঢোকে, খরচ হয় সামান্যই। এসব কারণেই সিজার মায়েদের ডেলিভারির মাস ছয়েকের মধ্যেই বেশ একটা নোয়াপাতি ভুঁড়ি হয়। তবে উপায়? উপায় হলো ব্যায়াম, কায়িক পরিশ্রম। নর্মাল ডেলিভারির দিন দশেক পরেই ফ্রি হ্যান্ড ব্যায়াম শুরু করবেন, সঙ্গে কয়েকটি আসন। নিয়ম করে রোজ অন্তত আধা ঘণ্টা হাঁটবেন। যেসব মহিলা (কুলি, মজুর) কায়িক পরিশ্রম করে তাদের কিন্তু প্রসবের পর ভুঁড়ি হয় না। পবন মুক্তাসন এবং ভুজঙ্গাসন শুরু করতে পারেন মাসখানেক পর থেকেই। সিজারের দু মাস পর থেকেই হালকা ব্যায়াম শুরু করে দিন, সঙ্গে হাঁটাহাটি। স্তন্যদায়ী মায়েদের স্বাভাবিক অবস্থার থেকে ৪০০-৫০০ কালরি শক্তি বেশি প্রয়োজন হয়। এ জন্য ঘি-তেল বেশি করে না খেয়ে কার্বোহাইড্রেট ও প্রোটিনজাতীয় খাদ্য বেশি করে খান। প্রয়োজনে আপনার চিকিৎসক বা ডায়েটিশিয়ানের পরামর্শ নেবেন। সিজার মায়েরা তিন মাস পর থেকেই নানা ধরনের যোগাসন করতে পারেন। 

পিল থেকে ভুঁড়ি! 
পিল অর্থাৎ গর্ভনিরোধক বড়ি। এতে থাকে ইস্ট্রোজেন এবং প্রোজেস্টেরন নামক দুটো হরমোনের বিভিন্ন আনুপাতিক মিশ্রণ। ইস্ট্রোজেন ডিম্বাশয় থেকে পরিণত ডিম্বাণু নির্গমনে বাধা দেয়। প্রোজেস্টেরন জরায়ুমুখের নিঃসরণ কমিয়ে ঘন করে তোলে। ফলে শুক্রাণু জরায়ুমুখে প্রবেশে বাধা পায়। প্রবেশ করলেও ডিম্বনালি পর্যন্ত গিয়ে ডিম্বাণুর সঙ্গে মিলিত হতে পারে না। গর্ভসঞ্চারও হয় না। ইস্ট্রোজেন এবং প্রোজেস্টেরন দুটিই সেক্স হরমোন। পিল খেলে শতকরা ২৫ জন মহিলার প্রথম ৬ মাসে কেজি দুয়েক করে ওজন বাড়ে, তারপর আর বাড়ে না। যদি বাড়তেই থাকে তবে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন। পিল সব মহিলার সহ্য হয় না। ডাক্তারের পরামর্শমতো পিল নির্বাচন করলে নানা সমস্যা এড়ানো যায়।

 কীভাবে কমবে ভুঁড়ি ভুঁড়ি কমাতে ডায়েটিং 
ডায়েটিং। একেবারে হালফ্যাশনের শব্দ। বঙ্গ তথা ভারতীয় ললনারা বিশ্বসুন্দরী হওয়ার পর এটি খুব জনপ্রিয় হয়েছে কিশোরী-তরুণীদের মধ্যে। তাদের ধারণা, ডায়েটিং মানে প্রায় না খেয়ে হাড় জিরজিরে হওয়া। অথচ ডায়েটিং হলো একটি বিজ্ঞানসমমত খাদ্য নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি, যার মূল কথা এমন পরিমাণে খাওয়া যাতে শরীরের ঠিকঠাক পুষ্টি হবে অথচ মেদবৃদ্ধি হবে না, শরীরটা বেশ ছিপছিপে-ঝরঝরে লাগবে। আমরা যাই- খাই না কেন, ঘুরেফিরে তাতে ৬টি খাদ্য উপাদান থাকে। প্রোটিন, ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেট, খনিজ পদার্থ, ভিটামিন ও মিনারেল। এগুলো থেকেই দেহ পায় তার চালিকাশক্তি, যার একক হলো ক্যালরি। প্রতিদিন কার কতটা শক্তি বা ক্যালরি প্রয়োজন, তা নির্ভর করে ব্যক্তির ওজন, উচ্চতা, গঠন, পরিশ্রমের ধরনসহ নানা ফ্যাক্টরের ওপর। ক্যালরি গ্রহণ বেশি হলে চর্বি জমতে থাকে সারা দেহে। তবে তলপেট বা ভুঁড়ির দিকেই নজরটা পড়ে আগে। ডায়েটিং করতে হলে অবশ্যই একজন অভিজ্ঞ ডায়েটিশিয়ানের সাহায্য প্রয়োজন। তিনিই পরীক্ষা করে বলে দেবেন দিনপ্রতি কত ক্যালরি শক্তি আপনার দরকার এবং তা পেতে কোন কোন খাদ্য কতটা পরিমাণে খাওয়া উচিত। তবু এ ব্যাপারে একটা প্রাথমিক ধারণা থাকা ভালো। মাঝারি মানের পরিশ্রম করেন এমন একজন পূর্ণবয়স্ক পুরুষের প্রতিদিন কমবেশি ২৪০০ ক্যালরি এবং পূর্ণবয়স্কা মহিলার ১৯০০ ক্যালরি প্রয়োজন। কায়িক পরিম্রম বেশি করলে এর সঙ্গে ৩০০ থেকে ৫০০ ক্যালরি যোগ করতে হবে, পরিশ্রম কম করলে ২০০ থেকে ৩০০ ক্যালরি বাদ দিতে হবে। তবে ভুঁড়ি কমাতে ডায়েটিং করলে ১৪০০ থেকে ১৬০০ ক্যালরি গ্রহণ করলেই যথেষ্ট। 

উচ্চ ক্যালরিযুক্ত খাবার যেমন- ঘি, মাখন, পনির, তেল, গুড়, চিনেবাদাম, রেড মিট, ইলিশ, চিংড়ি, চকোলেট, আইসক্রিম, চিপস, লজেন্স, কাজুবাদাম, কিসমিস, মিষ্টি, জ্যাম, জেলি, কেক, আলু ইত্যাদি খাদ্যতালিকায় কম রাখবেন। বরং খাদ্যতালিকায় রাখুন, অল্প ভাত, আটার রুটি, ছোট মাছ, মুরগির মাংস, দুধ ছাড়া চা-কফি, টক দই, মৌসুমী ফল, প্রচুর শাকসবজি ও তরিতরকারি। একবারে না খেয়ে অল্প করে বারে বারে খাবেন। দুম করে উপোস দিয়ে ওজন কমানোর চেষ্টায় কিন্তু হিতে বিপরীত হতে পারে। বরং ধীরে ধীরে কার্বোহাইড্রেট ও ফ্যাট জাতীয় খাদ্য কমিয়ে ফেলে বাড়ান প্রোটিন, ভিটামিন ও খনিজ পদার্থসমৃদ্ধ খাবার।
 ভুঁড়ি কমাতে রাতের খাওয়া খুব অল্প পরিমাণে রাত ৯টার মধ্যে সেরে ফেলুন। শোয়ার সময় এক গ্লাস ফলের রস খেতে পারেন, যদি অবশ্য খিদে পায়। ব্রেকফাস্টটা করবেন হেভি, দুপুরের লঞ্চটা হালকা, টিফিন করবেন মুড়ি, চিঁড়ে, খই এবং শসা দিয়ে।

 নিয়ম করে হাঁটুন
 হাঁটাহাঁটির অভ্যাস আমাদের প্রায় চলেই গেছে। গ্রামের মানুষকে হাঁটাহাঁটি করতেই হয় যানবাহনের অসুবিধা ও আর্থিক অস্বাচ্ছন্দ্যের কারণে। যে জন্য গ্রামের মানুষের ভুঁড়িসমস্যা অনেক কম। শহুরে মানুষ তো ঘর থেকে বেরিয়েই যানবাহন পেয়ে যান। ভুঁড়ি কমাতে হাঁটার মতো ভালো ব্যায়াম আর নেই। কিন্তু শখের হাঁটা নয়, হাঁটতে হবে নিয়ম করে, প্রতিদিনই। প্রশ্ন হলো হাঁটবেন কখন? মর্নিং ওয়াক আমাদের বেশি পছন্দ। সকালবেলায় রোদ থাকে না, প্রকৃতি থাকে শান্ত, ভালো থাকে মন-মেজাজও। তবে শরীরবিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ৬-৭ ঘণ্টা ঘুমের পর রক্তচাপ স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি বা কম থাকে, নাড়ির গতি কম থাকে, দেহের সব মাংসপেশিও শিথিল থাকে- এ সময় তাই ঘাম ঝরিয়ে না হাঁটাই ভালো। বরং ঘুম থেকে উঠে চা খেয়ে ঘরে একটু পায়চারি করে তারপর হাঁটতে বেরুনোই ভালো। বয়স্ক ব্যক্তি শীত-বর্ষায় বরং বিকেলে রোদ কমলে হাঁটাহাঁটি করবেন। 

কতক্ষণ হাঁটবেন জানতে চান অনেকেই। সুস্থ ব্যক্তি দিনে ঘণ্টায় ৩-৪ কিমি হাঁটার চেষ্টা করবেন। এতে শক্তিক্ষয় হবে ৩০০-৩৫০ ক্যালরি। প্রথম দিনেই এতটা হাঁটতে যাবেন না। প্রথম কদিন ১৫ মিনিট, তারপর ৩০ মিনিট, ধীরে ধীরে এক থেকে দেড় ঘণ্টা করে হাঁটবেন। ঘণ্টায় দু কিমি হাঁটলে শক্তি ঝরে ২০০ ক্যালরি, তিন কিমি হাঁটলে ২৫০ থেকে ৩০০ ক্যালরি। ভুঁড়ি কমাতে হাঁটার কোনো বিকল্প নেই। 

তবে বেশি হাঁটাহাঁটিতে খিদে পায় বড্ড বেশি। অতিরিক্ত আহারেই কিন্তু আবার ভুঁড়িবৃদ্ধি। তা ছাড়া রাস্তাঘাট ও পার্কের আশপাশেই থাকে নানা ফাস্টফুডের দোকান। এ ব্যাপারে আপনার রসনাকে সংযত রাখতেই হবে। আরেকটা কথা, একেবারে খালি বা ভরা পেটে হাঁটাহাঁটি একদম নয়। 

যোগাসনে ভুঁড়ি বিয়োগ
 নানা ধরনের আসন ও ব্যায়ামে ভুঁড়ি কমে ঠিকই, তবে তা করতে হবে কোনো যোগ্য প্রশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে। মনে রাখবেন, সবার জন্য সব আসন বা ব্যায়াম নয়। কোন ব্যায়াম কে কতক্ষণ ধরে প্রতিদিন করবেন, তাও ঠিক করে দেবেন প্রশিক্ষক। তবে এ ব্যাপারে কেউ যেন ম্যাজিক প্রত্যাশা না করেন। অন্তত তিন মাস না করলে কোনো উপকারই বোঝা যাবে না। মেদ কমতে শুরু করলেই হঠাৎ করে আসন বা ব্যায়ামগুলো বন্ধ করবেন না। চালিয়ে যেতে হবে সারা বছরই। আর তার সঙ্গে খাওয়ার ব্যাপারে সতর্ক তো থাকবেনই। ভুঁড়ি কমাতে যে আসনগুলো করা হয়ে থাকে তার মধ্যে আছে ত্রিকোণ আসন, ধনুরাসন, ভুজঙ্গাসন, পবন মুক্তাসন, উস্ট্রাসন, শলভাসন, উত্থাপদাসন, পশ্চিমোত্থনাসন, সিট-আপ, ল্যাটারাল ট্যুইস্টিং ইত্যাদি।

 যেতে পারেন জিমখানায় 
পাড়ায় পাড়ায় অলিতেগলিতে এখন জিমখানা। কে ভালো, কে খারাপ বিচারের দায় আপনার। ভুঁড়ি কমানোর কয়েকটি যন্ত্রপাতির সঙ্গে পরিচিত হোন। জিমখানায় উঁকি মেরে দেখে নেবেন ওগুলো আছে কি না। 

ওয়াকার 
হাঁটছেন অথচ এক ইঞ্চিও এগোচ্ছেন না। আপনাকে দাঁড়াতে হবে একটি রবারের প্লাটফর্মের ওপর, সেটিকে চলমান করলেই আপনি তার বিপরীত পাল্লা দিয়ে হেঁটে চলবেন। হাত দিয়ে ধরে থাকবেন দু পাশের দুটো হ্যান্ডেল। যে কোনো বয়সেই ওয়াকার ব্যবহার করা যায়।

 স্ট্যাটিক সাইকেল 
ভারী মজার। পাই পাই করে সাইকেল চালাচ্ছেন অথচ একটুও এগোচ্ছেন না। শুধু ভুঁড়ি নয়, এতে সারা দেহের মেদই ঝরে যায়। 

অবশেষে অপারেশন
 কোনোভাবেই যখন ভুঁড়ি কমানো যায় না, ডায়েটিং-ব্যায়াম-হাঁটাহাঁটি সবই যখন ব্যর্থ হয়ে যায়, তখন অপারেশনের কথা ভাবা যেতে পারে। অপারেশন দুটির নাম অ্যাবডোমিনোপ্লাস্টি এবং লাইপোসাকশন। 

ভুঁড়ি ও টিভি 
টিভি দেখলে কি ভুঁড়ি বাড়ে, মেদ বৃদ্ধি হয়? হয়, যদি একটানা অনেকক্ষণ ধরে টিভি দেখা যায় প্রতিদিন নিয়ম করে। এই বিষয়ে একটি সমীক্ষা রিপোর্ট সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ‘দ্য জার্নাল অব দি আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন’-এ। সমীক্ষকরা পঞ্চাশ হাজার রোগা মহিলার ওপর দীর্ঘ ৬ বছর ধরে গবেষণা চালিয়ে দেখেছেন এদের মধ্যে যারা সপ্তাহে ৩৫ ঘণ্টার ওপর টিভি দেখেন অর্থাৎ দিনে ৫ ঘণ্টা করে, সেসব মহিলার ২৩ ভাগ মেদ বৃদ্ধি হয়েছে। শতকরা হিসেবে ৭.৫ ভাগ। এই সমীক্ষা আরো জানাচ্ছে, আমেরিকান পুরুষরা সপ্তাহে গড়ে টিভি দেখেন ২৯ ঘণ্টা করে। মহিলারা দেখেন ৩৪ ঘণ্টা করে। 

কেন হয় এ ধরনের মেদবৃদ্ধি তথা ভুঁড়িবৃদ্ধি? দেহের বিপাকীয় কাজের হার কমে যাওয়াই এর নেপথ্য কারণ। আমরা যাই খাই না কেন, আমাদের অন্ত্রনালিতে নানা ধরনের উৎসেচক এবং পাচক রসের সাহায্যে তা সহজপাচ্য উপাদানে ভেঙে গিয়ে ক্ষুদ্রান্ত্রের শুঙ্গ সাহায্যে রক্তস্রোতে এসে মেশে, পৌঁছে যায় লিভারে। সেখানে আরো পরিবর্তিত হয়ে তারা দেহের কোষে কোষে পৌঁছে গিয়ে শক্তির জোগান দেয় ও কোষের ক্ষয়পূরণ, গঠন ও বৃদ্ধিতে অংশ নেয়। কোষ আবার যেসব ক্ষতিকর পদার্থ ত্যাগ করে, সেগুলো রক্তস্রোত বেয়ে রেচন প্রক্রিয়ার সাহায্যে দেহ থেকে নানাভাবে বের হয়ে যায়। এই যে শক্তির সংশ্লেষণ এবং একই সঙ্গে বিশ্লেষ, পুরো ক্রিয়াটাই হলো বিপাক ক্রিয়া। শরীরে নাড়াচাড়া কম হলে বিপাক ক্রিয়া ব্যাহত হয়ে দেহে শক্তি বা ক্যালরি জমতে থাকে, খরচ কম হয়। একটানা টিভি দেখতে দেখতে টুকটাক মুখ চলে অনেকেরই। স্ন্যাকস, ভাজাভুজিসহ নানা ধরনের ফাস্টফুড এ সময় বেশি খাওয়া হয়। এতেও দেহে প্রচুর ক্যালরি সঞ্চিত হয়ে মেদবৃদ্ধি হয়।

 কাজেই একটানা দীর্ঘক্ষণ টিভি দেখা উচিত নয়। সপ্তাহে ১০-১২ ঘণ্টার বেশি টিভি না দেখাই ভালো, গড়ে দিনে দেড় ঘণ্টা, খুব বেশি হলে দু ঘণ্টা। টিভি দেখতে দেখতে মুখ চালানোর অভ্যাস ত্যাগ করুন। আধাঘণ্টার বেশি একটানা টিভি না দেখে একটু হাঁটাহাঁটি করে নিন ঘরের মধ্যেই। 

ওষুধ খেয়ে ভুঁড়ি না কমানোই ভালো 
ব্যায়াম এবং ডায়েটিং না করে শুধু ওষুধ খেয়ে ভুঁড়ি ভ্যানিশ হয় না, সে কথা আগেই জানিয়ে রাখছি। তবু নানা বহুজাতিক সংস্থা বাজারে এনেছেন নিত্যনতুন ওষুধ। এ নিয়ে গবেষণাও থেমে নেই। অধিকাংশ ওষুধই অ্যাপেটাইট সাপ্রেশন পিল বা খিদে কমানোর বড়ি। এর মধ্যে রয়েছে- অ্যাম্ফিটামিন জাতীয় কিছু ওষুধ যেমন ফেন্টারমাইন। অল্প সময়ের জন্য এই বড়ি ব্যবহার করা হয়। ফিনাইল প্রোপানোলামাইন, এটিও অল্পদিনের বেশি ব্যবহার করা উচিত নয়। ফেনফ্লুরামাইন। সেরোটনিন নামক একটি হরমোন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষক থেকে। এই ফেনফ্লুরামাইন এবং ফেন্টারমাইনের মিশ্রণ ইদানীং বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে মেদ কমানোতে। তবে দীর্ঘদিন ব্যবহারে এর কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেছে যেমন- হার্টের ভালভের অসুখ, রক্তচাপ বৃদ্ধি ইত্যাদি।
সিবুট্রামাইন। রোজ একবার করে টানা ২৪ সপ্তাহ খেতে হয়। মেদবৃদ্ধির সঙ্গে যাদের রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইড বেশি থাকে, তাদের ক্ষেত্রে এই ওষুধ ভালো কাজ করে। ডায়াবেটিস এবং থাইরয়েডজনিত কারণে যারা মোটা হন, এই রোগগুলোর ঠিকঠাক চিকিৎসা করলে তাদের মেদও ঝরে যায়। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কখনো ভুঁড়ি কমানোর ওষুধ খাবেন না। তাছাড়া যত ওষুধই খান, ব্যায়াম এবং ডায়েটিং কিন্তু চালিয়ে যেতে হবেই।

ডা. অমিতাভ ভট্টাচায

1 comment:

  1. অনলাইন বেসরকারী স্বাস্থ্য সম্মত ডাক্তার
    ভিসিট করতে এই লিংকে প্রবেশ করুনঃ বেসরকারী স্বাস্থ্য সম্মত ডাক্তার

    ReplyDelete

Thanks for Comment

Copyright © 2013 MEDIA INFO