ব্যর্থতার জয় হোক : ডেনজেল

ডেনজেল ওয়াশিংটন যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত অভিনেতা, লেখক ও পরিচালক। দুবার জিতেছেন অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড, দুই গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ড। ডেনজেলের জন্ম ২৪ ডিসেম্বর ১৯৫৪। ২০১১ সালের পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে এই বক্তৃতা দেন তিনি।

এখানে আমন্ত্রণ পেয়ে আমি আসলেই অনেক গর্বিত ও কৃতজ্ঞতা বোধ করছি। আজ আমি একটু নার্ভাস। কারণ সমাবর্তনের মতো এমন একটি বৃহত্তর পর্যায়ে বক্তব্য দেওয়াটা অনেক কঠিন একটি ব্যাপার। আমার আয়েশি ধারার জীবনযাপনের একেবারে বাইরে। এর চেয়ে সৈনিকের পোশাক পরে কয়েকটি কঠিন শট দেওয়াটাও বোধ হয় সহজ ছিল। কিংবা কোনো ছবির শটে চলন্ত ট্রেন থেকে ছুড়ে দেওয়া হোক আমাকে; অথবা আমাকে ম্যালকম এক্স, রুবিন হ্যারিকেন কার্টারের মতো চরিত্রগুলোয় অভিনয় করতে বলা হোক— আমি রাজি হয়ে যাব। কিন্তু দিতে হবে একটি সমাবর্তনের বক্তব্য? এটি সত্যিই একটি গুরুতর ব্যাপার।
কীভাবে নতুন এই স্নাতকদের সামনে বক্তব্য দেব, সেটা নিয়ে বেশ ভেবেছিলাম। আমার মনে হয়েছিল, সবচেয়ে মনোযোগ ধরে রাখার ভালো উপায় হলো হলিউডের রসাল কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলে চলা। শুরু করা যেতে পারে আমেরিকান গ্যাংস্টার ছবির সেটে আমার আর রাসেল ক্রোর মধ্যকার বাগিবতণ্ডা নিয়ে। কিংবা অ্যাঞ্জেলিনা জোলির সঙ্গে আমার কাটানো কিছু আন্তরিক মুহূর্ত নিয়ে। কেউ কি তোমরা সেসব গসিপ শুনতে চাও? আমার তা মনে হয় না। তাই এভাবেই আমি বিপদে পড়ে গেলাম। তোমরা কি এখন ভাবছ যে এতটাই যখন কঠিন মনে হয়েছে বক্তব্য দেওয়া, তাহলে কেন আমি এ আমন্ত্রণে রাজি হলাম?
ভালো একটা কারণ হতে পারে যে তোমাদের মধ্যে আমার ছেলে বসে আছে। আমি এভাবে এসে দেখে গেলাম আমার অর্থ কীভাবে খরচ হলো তার পেছনে। অন্যান্য কারণ হতে পারে, নিজের প্রচারণার জন্য এখানে এসেছি। কিন্তু আমি এখানে এসেছি এই অসাধারণ ক্যাম্পাসের জন্য। আমি জানি, হয়তো আমি তোমাদের মধ্যে হাস্যকর কোনো বস্তুতে পরিণত হব। কিন্তু তার পরও আমাকে এই ঝুঁকিটা নিতে হবে। ঝুঁকি না নিলে আমি বুঝতে পারব না যে আমি সফল না বিফল হতে যাচ্ছি।
আর আমি যদি ব্যর্থ না হই, পড়ে না যাই, তাহলে কীভাবে বুঝব যে আমি কিসের সঙ্গে আঘাত খাব? আমি কী বলতে চাইছি বুঝতে চেষ্টা করো।
রেগি জ্যাকসন বেসবল খেলার ইতিহাসে বহুবার ব্যর্থ হওয়ার রেকর্ড গড়েছিলেন। টমাস আলভা এডিসন ১০০০ বার ব্যর্থ হওয়ার পর ১০০১তম বার বানিয়েছিলেন অভাবনীয় আবিষ্কার বৈদ্যুতিক বাতি। ব্যর্থতার প্রতিটি ধাপ তোমাকে সফলতার একেকটি ধাপ কাছে এগিয়ে নিয়ে আসে। আর তাই তোমাকে ঝুঁকি নিতে হবে। ব্যর্থ হতে হবে সফলতার জন্য।
তোমরা হয়তো অনেকের কাছেই এমনটা শুনেছ।
আমি তিনটি কারণ দেখাতে চাই, সে জন্য একে আমি এতটা গুরুত্ব দিচ্ছি। প্রথমত, জীবনের কিছু বিষয়ে তুমি ব্যর্থ হবে। এই ব্যর্থতাকে মেনে নাও। হয়তো তুমি হেরে যাবে, নিজের কাজে লজ্জিত হবে। দুর্বিষহ হয়ে উঠবে সবকিছু। এমনটাই হয়তো সবাই বক্তব্যে বলে। আমি বলব, এই ব্যর্থতাকেই আলিঙ্গন করো। কারণ ব্যর্থতা জীবনের অনেক ক্ষেত্রে অনিবার্য। আমার অভিনয়জীবনের শুরুটা ছিল একটি ছবির অডিশন দেওয়ার মধ্য দিয়ে। সেখানে গান গাইতে হবে। কিন্তু আমি তো গান গাইতে জানি না, অভিনয় জানি। সুতরাং আমার পক্ষে আর সেই ছবির চরিত্রটি পাওয়া সম্ভব হয় না। পুরোদস্তুর ব্যর্থ হয়ে সেখান থেকে চলে এসেছি। তারপর পরবর্তী অডিশন, পরেরটি, আবার পরেরটি, চলতেই থাকল। আমি খুব প্রার্থনা করছিলাম। কিন্তু আমার ব্যর্থতা যেন বহাল থেকেই চলল। কিন্তু আমার কিছুই মনে হয়নি তাতে। কারণটা কী জানো? সেলুনের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তুমি শেষমেশ সত্যিই চুল কাটার সুযোগ পেয়ে যাবে। আগের বছর আমি একটা নাটক করলাম, ফেনসেস। এবং তার জন্য আমি জিতেছিলাম টনি অ্যাওয়ার্ড। আমার সেখানে গাইতে হয়নি। কিন্তু পরিহাসটা ছিল যে এই সেই কোর্ট থিয়েটার, যেখানে আমি ৩০ বছর আগে অডিশন দিতে এসে ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেছি। তোমরা এখানে স্নাতক যারা বসে আছো, তোমাদের সেই প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা আছে সফল হয়ে ওঠার। কিন্তু ব্যর্থ হওয়ার সাহস কি আছে কারও?
আমার কাছে দ্বিতীয় কারণটা হলো, যদি তুমি ব্যর্থ না হও, তুমি চেষ্টা করবে না, নিজেকে শুধরোবে না। আমার স্ত্রী এ প্রসঙ্গে প্রায়ই বলে, যা তোমার নেই সেটি অর্জনের জন্য তোমাকে এমন কিছু করতে হবে যা তুমি কখনোই করোনি। লেজ ব্রাউন একটি কথা বলেছিলেন, ভেবে নাও তুমি মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে; তোমার আশপাশে তোমার অব্যবহূত সব গুণ অশরীরী আত্মার আকার ধারণ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে তোমাকে বলছে, তুমি আমাদের ব্যবহার করলে জীবনটা আরও সার্থক করতে পারতে, আমাদের কবরে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারতে। আমি আজকে উপস্থিত স্নাতকদের জিজ্ঞেস করতে চাই, তোমরা কতগুলো এমন সৎ গুণবিশিষ্ট আত্মাকে কবরে তোমার সঙ্গে নিয়ে যেতে দেবে না, বলো? এ পৃথিবীর বড্ড প্রয়োজন তোমাদের মেধা ও প্রতিভার।
ব্যর্থতাকে গুরুত্ব দিয়ে কথাগুলো বলতে চাওয়ার শেষ কারণটি হলো, আমাদের জীবন কিন্তু সোজা কোনো পথ নয়। আমি আমার শিক্ষাজীবন শুরু করেছিলাম ফোর্ডহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রি মেডিকেল পড়াশোনা দিয়ে, শেষ করেছিলাম যে কোর্সটি দিয়ে, কার্ডিয়াক মর্ফোজেনেসিস, যা উচ্চারণ করতেও আমার কষ্ট হয়। কারণ আমি ওই কোর্সে ফেল করেছিলাম। তারপর মনে হলো, আইন নিয়ে পড়ব। তারপর সাংবাদিকতা।
যেহেতু লক্ষ্যের ঠিক ছিল না, গ্রেডগুলোও তাদের ইচ্ছামতো নিচের দিকে নামতে শুরু করল। যখন জিপিএ হলো ১.৮ তখন কর্তৃপক্ষ বলল কিছুদিন সময় নিয়ে আবার শুরু করতে। আমি তখন আমার মায়ের পার্লারের কাজে সহযোগিতা করতে শুরু করলাম। আমার বেশ দিনটি মনে আছে, ১৯৭৫ সালের ২৭ মার্চ। মায়ের এক পরিচিতা একটি বই দিয়ে বললেন, তোমাকে একটা আধ্যাত্মিক দৈববাণী বলে যাই, হাল ছেড়ো না। তুমি সারা পৃথিবী ভ্রমণ করতে যাচ্ছ এবং কোটি কোটি মানুষের সঙ্গে কথা বলতে যাচ্ছ। আমি একটু ভড়কে গিয়েছিলাম। পরের বছর কানেকটিকাটে আমি একটি ক্যাম্পে উপদেষ্টা হয়ে কাজ করছিলাম। একজন আমাকে এসে বলল, ‘তুমি কি কখনো অভিনয় করার কথা ভেবেছিলে? তোমার উচিত ভেবে দেখা।’ আমি ফোর্ডহামে ফিরে শেষবারের মতো আমার ‘মেজর’ বদলে নিলাম। অভিনয় নিয়ে সারা পৃথিবীতে আজ আমি বেরিয়ে পড়েছি, কথা বলছি বহু মানুষের সঙ্গে।
তাই ব্যর্থতা নিয়ে ভয় পেয়ো না। ব্যর্থতা তোমাদের জীবনের বন্দী হয়ে থাকা জিনিসগুলো খুলে দেবে। কখনো থামিয়ে দিলেও ব্যর্থতা জীবনের অনেক সুযোগ খুলে দেয়। তাই কখনো আশাহত হোয়ো না, পিছিয়ে পোড়ো না। তোমার সবকিছু দিয়ে এগিয়ে যাও। জয় করো। এগিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যর্থ হও। অভিনন্দন সবাইকে।


Click here

0 comments:

Thanks for Comment

Copyright © 2013 MEDIA INFO